অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রবীন্দ্র-গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অন্যতম সম্মানিত অধ্যাপক। তাঁর গবেষণা, রচনা, সম্পাদনা ও শিক্ষাদান—সব মিলিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে এক প্রজ্ঞাময় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, বাংলা কথাসাহিত্য ও সাহিত্য-গবেষণার নানা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনন্য। দীর্ঘ শিক্ষকজীবনের পাশাপাশি তিনি উচ্চমানের গবেষণাগ্রন্থ, সম্পাদনা প্রকল্প ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভান্ডার।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৪ সালে যশোর জেলার (বর্তমান ঝিনাইদহ) কালীগঞ্জ থানার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা সৈয়দ আবুল কাশেম (১৯০১–১৯৯৭) ও মাতা মোসাম্মাৎ হাসিনা খাতুন (১৯০৮–১৯৮১)-এর তৃতীয় ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। পিতা চাকরিজীবী হওয়ায় তাঁর শৈশব-কৈশোরের বড় অংশ কেটেছে যশোর শহরে। বড় ভাই সৈয়দ আফজল হোসেন ও একমাত্র বোন ফাতেমা খাতুন রুবী নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। পারিবারিক শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুরাগ তাঁর মানসগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিক্ষাজীবন
সৈয়দ আকরম হোসেন ১৯৬০ সালে যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬২ সালে যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৬৫ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পরে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এবং ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহীম, আহমদ শরীফ, মুহম্মদ আবদুল হাই, আনোয়ার পাশা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আনিসুজ্জামান প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। এসব মহান শিক্ষকের সংস্পর্শ তাঁর চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং সাহিত্য-গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
কর্মজীবন
১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ১৯৭২ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৭৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৮৪ সালে পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি নিয়মিত অধ্যাপনা করেছেন এবং বর্তমানে সুপারনিউমারি অধ্যাপক হিসেবে একই বিভাগে কর্মরত আছেন।
শিক্ষাদানকে তিনি কেবল চাকরি হিসেবে দেখেননি; বরং পেশাকে তিনি দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে বাংলা বিভাগ সংকটের মুখে পড়লে তিনি সমস্যাগুলো সমাধানে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি ছাত্রবান্ধব শিক্ষক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। ক্লাসরুমের বাইরে তাঁর বাসায়ও সাহিত্য-আলোচনা, আড্ডা ও গবেষণার পরিবেশ গড়ে উঠত।
প্রশাসনিক ও বিশেষ অবদান
- ১৯৯১–১৯৯৩: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান
- ১৯৯৯–২০০১: বাংলা একাডেমির কার্যকরী সদস্য
- বাংলা বিভাগ ও একাডেমিক ক্ষেত্রের নানা সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা
- তরুণ গবেষকদের উৎসাহ প্রদান ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করা
রচনা ও গবেষণা-অবদান
গবেষণা গ্রন্থ
১. রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: দেশকাল ও শিল্পরূপ (১৯৬৯)
২. রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: চেতনালোক ও শিল্পরূপ (১৯৮১)
৩. বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৮৫)
৪. এস ওয়াজেদ আলী (১৯৮৬)
৫. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯৮৮)
৬. আবদুর রাজ্জাক (১৯৯০)
৭. প্রসঙ্গ: বাংলা কথাসাহিত্য (১৯৯৭)
সংগ্রহ ও সম্পাদনা
১. মুনীর চৌধুরী – মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী – আনোয়ার পাশা (১৯৭২)
২. এস ওয়াজেদ আলী রচনাবলী (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৮৫)
৩. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলী (প্রথম খণ্ড ১৯৮৬, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৮৭)
৪. রবীন্দ্র-রচনাবলী (১–৩০ খণ্ড), ঐতিহ্য (২০১৬)
দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ ও সম্পাদনা
১. আহৃতি – নরেশ সেনগুপ্ত (২০১০)
২. অগ্নি-সংস্কার – নরেশ সেনগুপ্ত (২০১১)
সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা
১. ১৩ বছর (১৯৭৮–১৯৯১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক
২. ‘উলুখাগড়া’ পত্রিকার সম্পাদক
পারিবারিক জীবন
১৯৬৮ সালে তিনি মোসাম্মাৎ উম্মে কুলসুমকে বিবাহ করেন। তাঁদের দুই ছেলে — সৈয়দ আজফর হোসেন ও সৈয়দ আরমান হোসেন। বড় ছেলে শিক্ষকতায় যুক্ত এবং ছোট ছেলে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
পুরস্কার ও সম্মাননা
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৯)
- বাংলা একাডেমির ‘ফেলো’
- বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-পুরস্কার (২০১৬)
- একুশে পদক (২০১৭)
- টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা— ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি (২০১৮)
- সাহিত্য ও রবীন্দ্র-গবেষণার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য সম্মাননা
অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্র-গবেষণার জগতে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে চলা এক উজ্জ্বল প্রদীপ। তাঁর গবেষণা, সম্পাদনা ও শিক্ষকতা—সব মিলিয়ে তিনি সমসাময়িক বাংলা বিদ্যা ও সাহিত্য-জগতের এক বিশিষ্ট স্তম্ভ।
