অতলান্ত খোঁজ: দর্শন, কাব্যিকতা আর জীবন-জিজ্ঞাসার ব্যতিক্রমী জগৎ
মুনশি আলিম
অতলান্ত খোঁজ কথাসাহিত্যিক নিলুফা আক্তার-এর একটি নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস। সমাবেশ থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রকাশিত। এ উপন্যাসের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে আত্মজিজ্ঞাসাময় প্রশ্নমালা। যে প্রশ্নগুলোর মধ্যে তত্ত¡-তথ্য-উপাত্ত-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতিসহ হেন কোনো বিষয় নেই যে উঠে আসেনি। সক্রেটিস বলেছিলেন—“নো দাইসেফল”। অর্থাৎ নিজেকে জানো। উপন্যাসে বর্ণিত কথকের ভূমিকাকেও যেনো একইরকম মনে হয়েছে। নিজেকে জানার জন্য, নিজেকে বোঝার জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য, নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য তার নিরন্তর ছুটে চলা। একজন নারী চাকরিজীবীর জন্য সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশে^র যেকোনো প্রান্তই এক ও অভিন্ন। বলা যায় বিরূপ আর প্রতিকূল পরিবেশ; আর নারীকে এসব মোকাবেলা করেই যে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হয়—‘অতলান্ত খোঁজ’ উপন্যাসে এরকমই বাস্তবচিত্র শৈল্পিক হয়ে ফুটে ওঠেছে।
‘অতলান্ত খোঁজ’ নিলুফা আক্তার-এর প্রথম উপন্যাস। সমাজের স্বাধীনচেতা নারীদের কর্মযজ্ঞ, যাপিতজীবন, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি বিষয়ই তাঁর রচনার মূল আকর্ষণ। উপন্যাসে দর্পণের মতো ফুটে ওঠেছে কর্মজীবী নারী সত্তার ভেতর ও বাহিরের নিটোল ক্যানভাস। প্রকৃত অর্থে লেখকের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতারই ছায়াপাত ঘটেছে এ উপন্যাসে।
প্রথমটায় গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। পাঠপূর্ব ধারণা ছিল পুরুষই হবে কেন্দ্রীয় চরিত্র! কিন্তু না; কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন কর্মজীবী নারী; যে বেসরকারি একটি একটি ব্যাংকে কর্মরত। তার বয়ানে উপন্যাসটির শুরু এবং শেষ। চরিত্রটি যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত।
অতলান্ত খোঁজ উপন্যাসে মৌলিক চরিত্র বা মূল চরিত্রগুলোর কোনোটিরও নাম নেই। না কথকের নাম, না কথকের পড়শি বন্ধু, না প্রবাসী বন্ধু, না তার ছেলের নাম, না তার অর্ধাঙ্গের নাম, না পিতার নাম, না মাতার নাম, না ডাক্তার ভাইয়ের নাম! প্রধান চরিত্রগুলোর নাম ছাড়াও যে বাংলা উপন্যাসের শুরু এবং সমাপ্তি হতে পারে অতলান্ত খোঁজ না পড়লে পাঠক এটা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারবে না। আমার ধারণা—বাংলা সাহিত্যে এটাই মূল চরিত্রগুলোর নাম বিবর্জিত প্রথম উপন্যাস! ভাবা যায়? মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কম লিখেছেন; কিন্তু যা লিখেছেন তা-ই সেরা হয়েছে। কথাসাহিত্যিক নিলুফা আক্তারও তাঁর প্রথম উপন্যাস অতলান্ত খোঁজ দিয়ে চমকে দিয়েছেন। উপন্যাসের পর্বে পর্বে চমকে ভরপুর রেখেছেন। উপন্যাসিক সচেতনভাবেই হয়ত উপন্যাসের নতুন প্যাটার্ন করতে চেয়েছেন। তবে জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক, তাঁর এ জায়গাতে কিন্তু তিনি শতভাগ সফল!
সেটিং বা পর্ববিন্যাস ভাগ করা হয়েছে ক-ৎ পর্যন্ত অর্থাৎ মোট ৩৬টি পর্বে। পুরো উপন্যাসটিই বর্ণিত হয়েছে উত্তম পুরুষে! এইযে দেখুন, উত্তম পুরুষ বললাম! এখানেও কিন্তু আপত্তি। কেননা ব্যাকরণে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ, নাম পুরুষ আছে কিন্তু কোথাও উত্তম মহিলা, মধ্যম মহিলা, নাম মহিলা নেই! পুরুষতান্ত্রিক ব্যাকরণিক দৃষ্টিকোণ আরকি! আমি একটু সংশোধন করে বলছি—উপন্যাসটি বর্ণিত হয়েছে উত্তম পক্ষে। কী, এবার হলো তো?
“সেদিনের ঘটনার পর থেকে ভাবছি, আসলে আমি কেমন আছি”—উপন্যাসটির শুরুই হয়েছে আত্মকেন্দ্রিক প্রশ্ন দিয়ে। শেষটাতেও রয়েছে বিস্ময়সূচক বাক্য আর প্রশ্নমালা। “কে সত্য তবে, আমি নাকি আমার বন্ধু? আহা জীবন নামক এই অতলান্ত খোঁজ-এর শেষ কোথায় কে জানে!”
প্রশ্নে প্রশ্নে যে উপন্যাসের শুরু এবং শেষ করা যায় এই উপন্যাস না পড়লে তা অনেকটা বোধের বাইরেই থেকে যেত। ১৯৭১ সালে সাহিত্যে পুরস্কারপ্রাপ্ত পাবলো নেরুদাও তার কাব্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জুড়ে কবিতার ভুবন তৈরি করেছিলেন। প্রশ্নে প্রশ্নে যেমন কবিতা হয়, তেমনই উপন্যাসও হয়। আমরা দেখেছি পত্রের পর পত্র জুড়ে দিয়েও উপন্যাস হয়।
বাংলা সাহিত্যে পত্রোপন্যাস খুব বেশি লেখা হয়নি। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের পোনুর চিঠি, কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধন হারা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রিয়তমাসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ক্রৌঞ্চমিথুন ও তরুণকুমার ভাদুড়ীর সন্ধ্যাদীপের শিখা উল্লেখযোগ্য। কাজেই বলা যায়, উপন্যাসের মৌলিকত্ব থাকলে, উপন্যাস লেখার মৌলিক উপকরণ থাকলে যেকোনো প্রকরণেই তা লেখা যায়। এদিক বিবেচনায় নিলুফা আক্তার ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক।
পুরো উপন্যাসেই রয়েছে কাব্যিক ঢং। সাড়ে উনিশ ফর্মার এই উপনাস্যে পাঠকমাত্রেই সে রসে সিক্ত হবে। একেক উপন্যাসের থাকে একেক রকম ভাব, প্রকরণ, প্রকৌশল, চিত্রকল্প কিংবা প্লট। যেমন—অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচনামাত্রেই আধ্যাত্মিকতার সুঘ্রাণ মেলে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা মানেই নিটোল বাস্তবতার সুঘ্রাণ মেলে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস মানেই মহাকাব্যিকতার সুঘ্রাণ! উপন্যাসিকমাত্রেই তাঁর উপন্যাসে নিজস্ব দর্শন বা চিন্তার প্রলেপ দিবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে সব উপন্যাসই পাঠককে ভাবিয়ে তুলে না, কোনো কোনো উপন্যাসই পাঠককে ভাবিয়ে তুলতে পারে, বিগলিত করতে পারে, পাঠকের ভেতরের সত্তায় অনুরণন তুলতে পারে। উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকহৃদয়কে টানাপোড়েনে ফেলা, ভেতরে ক্ষরণ সৃষ্টি করা সকলের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তবে কেউ কেউ পারে। ‘অতলান্ত খোঁজ’ উপন্যাস পাঠেও পাঠক আন্দোলিত হবে, ঘটনার অতিশায়নে পাঠকহৃদয়ে ক্ষরণ ঘটবে বলেই আমার বিশ্বাস।
উপন্যাসের ১৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চাকরিজীবী নারীর সামাজিক প্রতিবন্ধকতার স্পষ্টরূপ! নারীর চাকরি, নারীর স্বাধীনতা আসলে কে চায়? কত জনে চায়? উপন্যাসের কথক বলেছেন—“অথচ আমরা দু’জন শুধু ব্যক্তিত্বের দ্ব›েদ্ব ছয় বছর ধরে পৃথক বাস করছি। চাকরি করার ইচ্ছে পোষণ করার পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে আমার মনোমালিন্যের সূত্রপাত।”
উপন্যাস বিনির্মাণে কথাসাহিত্যিককে নিঃসন্দেহে অনেক পঠনপাঠন করতে হয়েছে। বিদেশি স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হয়েছে। উপন্যাসের ঘটনাগুলো যেনো চিত্রকল্পের মতোই একে একে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হতে থাকে। মূলত যারা এমনটি পারেন তারা নিঃসন্দেহে সেরা। এদিক বিবেচনায় ‘অতলান্ত খোঁজ’-এর ¯্রষ্টা নিলুফা আক্তার নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে নিরবচ্ছিন্ন পঠনপাঠন না করলে এর রসদ সুচারুরূপে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
“নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী”—কথাটি ভার্জিনিয়া উলফের। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী যেখানে অবরুদ্ধ, পুরুষের শক্তির কাছে সে বন্দিনী, তাকে বারংবার হতে হয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বলি। নারীর সম্মান যে সমাজে হয় পদে পদে ভুলুণ্ঠিত, সেই নারীজাতির ও নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন কথাসাহিত্যিক নিলুফা আক্তার। তিনি দেখিয়েছেন, নারীদের সহযোগিতার জন্য সত্যিকারে কোনো দেশ নেই, সমাজ নেই, রাষ্ট্র নেই। পুরুষমাত্রেই নারীকে তার অধীনস্ত করে রাখতে চায়। পুরুষ, নারীর কোনোরূপ স্বাধীনতাতেই বিশ^াস করে না। না আদি যুগে, না মধ্য যুগে, না আধুনিক যুগে। নারীকে তার কণ্টকাকীর্ণ পথ নিজেকেই পরিষ্কার করে সম্মুখপানে এগিয়ে চলতে হয়।
তবে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রবাসী বান্ধবী এবং প্রতিবেশী যাকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘বিষণœ ভেনাস’ নামে—চরিত্রদ্বয় প্রত্যাশার চেয়েও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কিশোর ছেলের সংলাপ এবং আচরণও বাস্তবধর্মী আর যুতসই মনে হয়েছে।
প্রকরণ, ভাষাশৈলিতা আর কাহিনির ঘটনঘটায় বলা যায়—এটি সত্যিই অপূর্ব শিল্পরসে সমৃদ্ধ একটি উপন্যাস। তাঁর উপন্যাসটিতে সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলোকে মনে হয় চিরপরিচিত অথচ রহস্যে ঘেরা, প্রতিবাদী, স্বাধীনচেতা, যুক্তিবাদী আর আধুনিক মনোভাবাপন্ন। এই চরিত্রগুলো বাস্তবের মতোই জীবন্ত। তাঁরা যেনো রয়েছে আমাদের সমাজেই। আমাদের পরিবার, সংসারের ভেতরেই তাঁরা যেনো আজও বিদ্যমান আছে। অনেক যতœ করে নিলুফা আক্তার এই নারী চরিত্রগুলোর নির্মাণ করেছেন। তাঁর এক একটি নারী চরিত্র, এক এক রকমের। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা সত্তার অধিকারী। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কাজেই বলা যায়—চরিত্রচিত্রণে তিনি একজন দক্ষ করিগর।
তাঁর নারী চরিত্রগুলোর জীবন-জিজ্ঞাসাগুলোকে মনে হয় বিস্ময়কর। চরিত্রগুলো যথেষ্ট সংগ্রামী আর আত্মপ্রত্যয়ী। তাঁর উপন্যাসের নারী চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে নারীজাতির দয়া-মায়া, ক্ষমা, ঔদার্য, সহনশীলতাসহ নানা চিরন্তন গুণগুলি। নিজের সত্তা দিয়ে একেবারেই নিজের মতো করে চরিত্রগুলোকে তিনি চিত্রণ করেছেন।
উপন্যাসে যেমন কাহিনি থাকে, তেমনই থাকে উপকাহিনি। এই কাহিনি এবং উপকাহিনির গ্রন্থন বা মেলবন্ধনই সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। কাহিনি যখন শিল্পোত্তীর্ণ হয় তথনই তা প্রাণ পায়; আর তখনই পাঠক রসে সিক্ত হয়। ভাবাবেগের জলে অবগাহন করে। আর এ রস সৃষ্টি করাই লেখক-জীবনের সার্থকতা। উপন্যাসটিতে শৈল্পিকভাবেই ফুটে ওঠেছে নারীর সংগ্রামমুখর জীবনের নানাদিক।
সাংসারিক কেমেস্ট্রি সৃষ্টিতে কথাসাহিত্যিক তার সেরাটাই দিতে চেয়েছেন। ঘটনার পরম্পরা রক্ষা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। প্রাসঙ্গিক উপমার জগত থেকে ঘুরে এসে মূলে ফেরা সত্যিই অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অনেকে পরম্পরা রক্ষা করতে গিয়ে মূল থেকেই বিচ্যুত হয়ে পড়েন। এদিক থেকে কথাসাহিত্যিক নিলুফা আক্তার সত্যিই ব্যতিক্রম।
তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্র সত্যিই অপরূপা! তাঁর রূপের নেই শেষ। সে যেমন স্বামী, পুত্র, কন্যাসহ সুন্দরভাবে একাই তাঁর ঘর সংসার পারে সামলাতে, ঠিক তেমনই সে মা দুর্গার মতো অস্ত্র হাতে নিয়ে মহিষাসুরদের বধও করতে পারে। নারী হলো অসীম শক্তিশালী। তাঁর শক্তির নেই কোন সীমা-পরিসীমা। কথাসাহিত্যিক নিলুফা আক্তার নারী চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে করেছেন নারীজাতির বন্দনা। উন্মোচন করেছেন নারীর ভেতরের সুপ্ত শক্তি।
অতলান্ত খোঁজ উপন্যাসের প্রায় পুরো শরীর জুড়েই লেপটে রয়েছে আধুনিক জীবনের ক্ষতাক্ত চিত্র। পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব যে—পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র বা সমগ্র বিশে^ প্রভাবিত সে ইঙ্গিতও তিনি তাঁর উপন্যাসে সূ²কৌশলে উপস্থাপন করেছেন। আর সে বলয় ভেদ করা খুবই দুরূহ! এককথায় এ উপন্যাসে নাগরিক জীবনকে, নারী-হৃদয়কে মনস্তাত্তি¡কভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাঁর রচনার ক্যানভাসে অবলীলায় স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে ক্লেদাক্ত নাগরিক জীবনের ভেতরবাহির আর নিঃসঙ্গ নারীর অবস্থান।
ঔপন্যাসিক নিজের আদর্শ দিয়ে রূপায়ণ করেছেন মূল চরিত্রটি। এককথায় বলা যায় তিনি যেনো চরিত্রচিত্রণের এক দক্ষ কারিগর। ঔপন্যাসিকের লেখনির সূ² আঁচড়ে কথকের মা, বাবা (সাব-জজ), ডাক্তার ভাই, মেসোমশাই, স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম, বুয়া, জজ মিয়া, পুলিম ইন্সপেক্টর, পিসতুতো দাদা, খোকা, খোকার বন্ধু, খোকার বন্ধুর ভাইবোন, খোকার বন্ধুর মা (বিষণœ ভেনাস), খোকার বন্ধুর বাবা, খোকার বাবা (আমলা), পিয়ন, মোটা সোনার চেইনপরা ব্যাংকগ্রাহক, মিসেস সিদ্দিকা সাত্তার, গুলাব মিয়া, খালাত বোন, বাবুর্চি, চাপরাশি, রাশিয়ান মেয়ে (কথকের ভাবি), বৃদ্ধা দাই, বুবু, ছাদু মাস্টার, ননাসের ছেলে, বেয়ারা, ড্রাইভার, মালি, বড়ো কর্তা (ডিরেক্টর), ডিরেক্টরের ছেলে (কথকের ভাষায় লম্পট!), ডিরেক্টরের ছেলের বান্ধবী (সিনিয়র ব্যাংক অফিসার—যে ম²ীরানি হিসেবে পরিচিত), প্রফেসর, ঠাকুরদা, পড়শি বান্ধবী (বিষণœ ভেনাস)-এর দুই দাদা এবং বাল্যবন্ধু (যে এখন প্রবাসী) প্রমুখ পার্শ¦চরিত্রগুলো প্রাণ পেয়েছে। পাশাপাশি প্রধান চরিত্রের সঙ্গেও এসব চরিত্রের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজেস ও সুসামঞ্জস্যতা। মূলত এসব চরিত্রের কারণেই প্রধান চরিত্রত্রয় ফুলে-ফেঁপে ওঠেছে। উপন্যাসে বেশি সময় জুড়ে প্রবাসী বন্ধুর উপস্থিতি থাকলেও পড়শি বন্ধুর চরিত্রই তার তুলনায় বেশি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠেছে। তবে সকল চরিত্রকে ছাপিয়ে সন্ধ্যা তারার মতোই যে ধ্রæব হয়ে উঠেছে—সে হলো ‘খোকা’ চরিত্র; যদিও সব পর্বে তার উপস্থিতি নেই।
উপন্যাসের সংলাপগুলোতেও রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ততার যথেষ্ট ছড়াছড়ি। মনে হবে যেনো চমকের আড়ৎ! সেরা কথাসাহিত্যিকরা তাদের কর্মের মধ্যেই সেরাটা রেখে যান। নিলুফা আক্তারের ‘অতলান্ত খোঁজ’ উপন্যাসে পাঠক আবেগে সিক্ত হবে, চিন্তায় পর্যুদস্ত হবে আবার জীবনযুদ্ধে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয় তার নানারকম বয়ানসহ সূ² দিকনির্দেশনাও পাবে।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে। বিশেষ করে ভাষার সরলীকরণ এই উপন্যাসের মাহাত্ম্যকে অনেকটাই বেগবান করেছে। যথাসম্ভব সরল বাক্যের পথ ধরেই তিনি হেঁটেছেন। বিশেষ করে চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ চয়নে নিঃসন্দেহে তিনি সিদ্ধহস্ত। বিশেষ করে কথকের পাশের পাশার ফ্ল্যাটের স্কুলশিক্ষক-এর কাজের মেয়ের সংলাপ “বাড়িত যাই কি করমু স্যার? আঁরে মারি হেলাইলেও বাড়িত যাইতান্য। ম্যাডাম মারি হেলাইলেও থাকুম।আঁ’র ভুল করি শিক্ষা হইসে, আর এইচ্চা কাম কইরতান্য।” এরকম বহু চরিত্রের মুখের সংলাপই বাস্তবতার নিরিখে সৃষ্ট; যা পড়ামাত্রই পাঠক বাস্তবতার সুঘ্রাণ পাবে, ভাষাপ্রেমে আসক্ত হবে।
উপমা আর বুলেট বাক্যের ব্যবহারেও তিনি বেশ সচেতন। প্রধান চরিত্রের সংলাপগুলোকে যেমন দার্শনিক পদবাচ্যের আবহে গড়ে তুলেছেন তেমনই পাশর্^ চরিত্রগুলোর মুখে যুতসই সংলাপ চয়নের মাধ্যমে নিটোল বাস্তবতাকেই জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করেছেন। সংলাপগুলো যেখানে যেমন হওয়া উচিত ঠিক যেনো সেরকমই হয়েছে। কোথাও কোনোরকম জড়তা পরিলক্ষিত হয় না। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পঠনপাঠনে পাঠক ঘটনার পাশাপাশি দার্শনিক তত্ত¡ এবং তথ্যও খুঁজে বেড়ায়; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় কাব্যময়তা, অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপন্যাসে পাঠক খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সুঘ্রাণ আর নিলুফা আক্তার-এর উপন্যাসে পাওয়া যায় কঠিন বাস্তবতার সুঘ্রাণ!
অতলান্ত খোঁজ উপন্যাসটি কাব্যময়তায় ভরপুর। উপন্যাসের ক্ষেত্রে কাব্যময়তা মোটেও দোষের নয়, বরং গুণ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বাংলা সাহিত্যের তিন সেরা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের লেখনিতে কাব্যময়তা মোটেও অস্বীকার করা যায় না। কাব্যময়তার বিশেষ প্রভাব পড়েছে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসে। কেউ কেউ তো আবার এই উপন্যাসকে মহাকাব্য বলেও স্বীকার করে নেন। বাংলা সাহিত্যের কিছু কালজয়ী উপন্যাসের মধ্যে নিঃসন্দেহে পথের পাঁচালী অন্যতম। কাব্যময়তা নিয়ে যদি এটি কালজয়ী হতে পারে তবে এটা বলা য়ায় কাব্যময়তা উপন্যাসের জন্য মোটেও অবাঞ্ছিত বা অপ্রয়োজনীয় কোনো বিষয় নয়। বরং কথাসাহিত্যে এটাও একধরনের অলংকরণ হিসেবে বিবেচিত।
উপন্যাসের ভাষার সরলীকরণে পাঠকমাত্রেই আকৃষ্ট হবে। জীবন-জিজ্ঞাসায় ভরপুর এ উপন্যাসের চরিত্রগুলোকেও মনে হবে চিরচেনা। ঘটনাগুলোতে বিস্ময়কর কিছু না থাকলেও তা উপস্থাপনে রয়েছে অভিনবত্ব আর যথেষ্ট পারঙ্গমতা; যা পাঠকমাত্রেই অনুধাবন করতে পারবে। তবে প্রবাসী বান্ধবী চরিত্রকে অবাধ স্বাধীনতা না দিয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণেও রাখা যেত পারত। কথকের স্বামীকে আরও একটু পুরুষালি করলে উপন্যাসটি হয়ত ভিন্ন রকম ব্যঞ্জনা পেতে পারত।
তাঁর উপন্যাসের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে বাস্তব ও রোমান্টিকজগতের জটিল থেকে জটিলতর দিকগুলোকেই তিনি অবলীলায় উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর লেখার প্লট, ভাব, ভাষা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ চয়ন, সন্নিবেশ, পরম্পরা, কাহিনির গভীরতা, সময়ের ঐক্য, ব্যাপ্তি, সমাপ্তি সবকিছু মিলিয়ে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে অনন্য। কথাসাহিত্যিক বিষয়বস্তুর ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনায় উপন্যাসের প্যাটার্নকে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ করেছেন। শৈল্পিক ছোঁয়ার কথা না-হয় নাই বা বললাম!
‘অতলান্ত খোঁজ’ উপন্যাসের প্রতিটি পর্বেই রয়েছে পাঠককে ধরে রাখার জন্য চুম্বকাংশ। আছে আবেগের ঘনঘটা। আছে প্রত্যেকটি ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ। কাহিনির সূত্র ধরে পাঠক অবলীলায় হেঁটে চলবে বলেই আমার বিশ^াস। এককথায় পাঠককে ধরে রাখার জন্য যে যে গুণগুলো অপরিহার্য তার পুরোটাই যেনো এই উপন্যাসে রয়েছে। আমার বিশ^াসপ্রত্যেক পাঠকমাত্রেই এটা স্বীকার করবে। আর এখানেই যে ঔপন্যাসিক নিলুফা আক্তারের সার্থকতা। তবে চরিত্রের জীবনজটিলতার ভাঁজগুলো উন্মোচনের জন্য পাঠককে পুরো উপন্যাসটিই পড়তে হবে।


Leave a Reply