হাসন রাজা: জীবনী

Spread the love

হাসন রাজা: জীবনী

(Hason Raja: Biography)

 

ভূমিকা

হাসন রাজা বাংলা লোকসাহিত্যের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মরমিয়া ধারার একজন অনন্য সাধক ও কবি, যিনি সুর, ভাব এবং আত্মজিজ্ঞাসার এক বিস্ময়কর সংমিশ্রণে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য গান। “লোকে বলে ঘর-বাড়ি ভালা নাই রে হাসন রাজা” — এই একটিমাত্র পঙক্তি আজও বাংলার লোকমানসে এক দার্শনিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

হাসন রাজার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়—একদিকে জমিদার ও ধনী ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে আত্মানুসন্ধানী, দার্শনিক এবং বৈরাগ্যবাদী কবি। এই জীবনীতে আমরা তাঁর জন্ম, শৈশব, পারিবারিক ইতিহাস, সাহিত্যকর্ম, দর্শন ও প্রভাব বিশ্লেষণ করব।

জন্ম ও পরিবার

হাসন রাজা জন্মগ্রহণ করেন ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ সালে, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরে (বর্তমানে বাংলাদেশ)। তাঁর পুরো নাম ছিল দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। তিনি ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া সন্তান। তাঁর পিতা আলী রাজা চৌধুরী এবং মাতা হুরমত জাহান বিবি

পিতার মৃত্যুর পর হাসন রাজা খুব অল্প বয়সে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

শিক্ষা ও জীবনধারা

হাসন রাজার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন খুব দীর্ঘ ছিল না। তবে তিনি ফারসি, উর্দু, বাংলা ও আরবি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। একসময় বিলাসিতাপূর্ণ জীবনযাপন করলেও জীবনের এক পর্যায়ে তিনি গা ঢেকে দেন আত্মজিজ্ঞাসা, আধ্যাত্মবাদ ও মানুষের প্রতি প্রেমে।

আধ্যাত্মিক রূপান্তর

হাসন রাজার জীবন বদলে যায় এক গভীর আত্মদর্শনের মধ্য দিয়ে। ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি একধরনের আত্মিক শূন্যতা অনুভব করতেন, যা তাঁকে নিয়ে যায় মরমি সাধনার পথে। তিনি সুফিবাদ ও বৈষ্ণব ভক্তিধারার প্রভাবিত কবি ছিলেন।

তাঁর গানে “আত্মা”, “সাঁই”, “প্রেম”, “জগতের অসারতা”, “অহং ত্যাগ”, ও “মানবপ্রেম” — এই বিষয়গুলো বারবার ফিরে আসে।

সাহিত্য ও সঙ্গীতকর্ম

হাসন রাজা মূলত একজন লোককবি ও গীতিকার ছিলেন। তাঁর রচনায় আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরপ্রেম, মানবতাবাদ এবং জীবনের অসারতা ফুটে উঠেছে গভীরভাবে।

উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য:

  • সহজ-সরল ভাষা, কিন্তু গভীর দার্শনিক ব্যঞ্জনা
  • আত্মসন্ধানী ও ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি
  • মানবপ্রেম ও বৈরাগ্যবাদের দার্শনিক রূপ
  • সুর ও ছন্দে লোকগীতি ও পালাগানের প্রভাব

বিখ্যাত গান:

  • লোকে বলে ঘর-বাড়ি ভালা নাই রে হাসন রাজা
  • আমি ভাওয়াল রাজা না ময়মনসিংহ গাজী
  • আল্লারে খুঁজতে গিয়া মাটির ভিতর পাইছি
  • ও-মোর রূপালী নদীর ধারে
  • কোন বাগানে যাও ফুল বুলবুলি রে

গ্রন্থ ও সংকলন

হাসন রাজা নিজ হাতে গান লিখে রাখতেন। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশ না পেলেও পরে বিভিন্ন গবেষক ও অনুরাগী তাঁর গান সংকলন করেন।

উল্লেখযোগ্য সংকলন:

  • হাসন রাজার গান (প্রথম সংকলন, প্রকাশ: ১৯০৭)
  • হাসন রাজা সংকলন (পরে বহুবার পুনর্মুদ্রিত ও গবেষণামূলক সংস্করণে প্রকাশিত)

হাসন রাজার ধর্মচিন্তা ও সুফিবাদ

হাসন রাজার গানে ইসলামী সুফিবাদ ও হিন্দু বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর “সাঁই” অর্থাৎ পরম সত্তা—এই চিন্তা ইসলামি ‘তাওহিদ’ ও হিন্দু ‘ব্রহ্ম’ দর্শনের এক ধরণের মিলনের দৃষ্টান্ত। তিনি মানুষকে বাহ্যিক আচারে নয়, অন্তরের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাস করতে শেখান।

সামাজিক জীবন ও দানশীলতা

তিনি শুধু কবি বা সাধক ছিলেন না, ছিলেন এক দানশীল ও মানবতাবাদী মানুষ। গরিব-দুঃখীদের সহায়তা, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুদান দান ইত্যাদি কাজেও তিনি স্মরণীয়।

মৃত্যু

৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে হাসন রাজা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সুনামগঞ্জ শহরে নিজ পৈত্রিক বাড়ির কাছেই দাফন করা হয়। তাঁর স্মৃতিরক্ষায় বর্তমানে সেখানে “হাসন রাজা জাদুঘর” প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

হাসন রাজার প্রভাব

হাসন রাজা বাংলা লোকসঙ্গীত ও মরমী সাহিত্যে এক অনন্য নাম। তাঁর গান শুধুমাত্র সিলেট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পুরো বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাউল সাধক এবং আধুনিক শিল্পীরাও তাঁর প্রভাব স্বীকার করেছেন।

বাংলাদেশের অনেক গীতিকার ও শিল্পী হাসন রাজার গান সংগ্রহ ও পরিবেশন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নাকি একবার বলেছিলেন, “এই লোক-সাধকের গানে অপার সত্য লুকানো আছে।”

উপসংহার

হাসন রাজা ছিলেন বাঙালি লোকসাহিত্যের এক অপূর্ব সাধক, যিনি জমিদারি জীবনের মোহ কাটিয়ে আত্মার সন্ধানী এক বাউল কবিতে পরিণত হন। তাঁর গান ও দার্শনিক চেতনা আজও আমাদেরকে ঈশ্বরপ্রেম, মানবপ্রেম ও আত্মজিজ্ঞাসার পথ দেখায়। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁর হৃদয়ভরা ছিল করুণা, প্রজ্ঞা ও প্রার্থনার ছায়ায়।

হাসন রাজা: জীবনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *