সমাস : প্রকারভেদসহ বিস্তারিত আলোচনা

Spread the love

সমাস

সমাস একটি ব্যাকরণ সম্মত প্রক্রিয়া যেখানে বাক্যের মধ্যে পরস্পর অর্থসম্বন্ধ যুক্ত দুই বা ততোধিক পদ/শব্দ/অর্থমূল পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়।এর ফলে বাক্যে “পাশাপাশি অবস্থানকারী পদগুলো একত্রে মিলিত” হয় এবং “নতুন শব্দ গঠিত হয়”। সমাসের রীতি সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে এবং এটি বাংলা ব্যাকরণের রূপতত্ত্ব অংশে আলোচনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ:

দেশের সেবা = দেশসেবা

সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন

বাক্যে অধিক শব্দের ব্যবহার কমানোর জন্য সমাস একটি কার্যকর পদ্ধতি। সাহিত্যিক প্রয়োজনেই সংস্কৃত ভাষায় সমাসের আবির্ভাব হয়েছিল বলে মনে হয়।

ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা

সমাস শব্দের অর্থ সংক্ষেপণ, সমর্থন,[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] সংগ্রহ,মিলন, একত্রে অবস্থান,, একাধিক পদের একপদীকরণ।[৩] শব্দটির তিন ধরনের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়:

প্রত্যয়গত: সম্‌ + √অস্‌ + অ (ঘঙ)

সন্ধি: সম্ + আস

সমাসের মাধ্যমে: এক হওয়া (সম্‌= এক, আস= হওয়া)

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে,

“পরস্পর অর্থ সঙ্গতি বিশিষ্ট দুই বা বহুপদকে একটি পদ করার নাম সমাস।”

ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে,

“অর্থের দিক দিয়া পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ আছে এরূপ দুই (বা তাহার অধিক) পদ মিলিত হইয়া একপদে পরিণত হইলে ব্যাকরণে সেই মিলনকে বলা হয় সমাস।”

ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে,

“পরস্পর অন্বয়যুক্ত দুই বা ততোধিক পদের (শব্দ নহে, কেননা শব্দ অন্বিত হইলে পদের পরিণত হইয়া যায়। মধ্যবর্তী অন্বাংশ (তাহা বিভক্তিও হইতে পারে, অন্য পদও হইতে পারে) লোভ করিয়া পদগুলিকে এক শব্দে (পদে নহে, কেননা, সমাসবদ্ধ পদের শেষে শব্দবিভক্তি যুক্ত হয়) পরিণত করার প্রক্রিয়ার নাম সমাস।”

ইতিহাস

সংস্কৃতে সমাসের ব্যবহার তার পিতৃভাষা প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। এখান থেকেই বাংলা ভাষায় সমাসের ব্যবহার এসেছে। ভাষাটির পরবর্তী পর্যায়ে সমাসের এই বিকাশ সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম, সাহিত্যিক প্রয়োজনে এবং কথ্য ভাষায় প্রতিফলিত হয় না।

যাইহোক, পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত ও জাত ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহে সমাস তৈরির উপাদানের (সমাসের অঙ্গ) সংখ্যা এবং সাহিত্যে সমাসের ব্যবহার উভয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিস্তার লাভ করেছে, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের মাঝে অনন্য।

সন্ধির সঙ্গে পার্থক্য

আরও দেখুন: সন্ধি

সন্ধি ও সমাস উভয়ের অর্থ মিলন, তথাপি এদের মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান। সন্ধিতে মিলন ঘটে সন্নিহিত বর্ণ বা ধ্বনির, সমাসে মিলন ঘটে পাশাপাশি থাকা একাধিক শব্দের/পদের। উদাহরণস্বরূপ, সংখ্যাতীত শব্দটিকে সমাস ও সন্ধির নিয়মে ভাঙলে পাওয়া যায়:

সন্ধি: সংখ্যা + অতীত = সংখ্যাতীত

সমাস: সংখ্যাকে অতীত = সংখ্যাতীত

সমাস ও সন্ধির মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো সমাসে দুই বর্ণের মধ্যে সাধারণত অব্যয় পদ ব্যবহার করা হয়,[২] কিন্তু অব্যয় পদের সঙ্গে কখনো সন্ধি হয় না।

তবে শব্দ গঠনের সময় সন্ধি ও সমাস একইসঙ্গে ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সিংহ চিহ্নিত যে আসন= সিংহাসন। এখানে সমাসের ফলে চিহ্নিত যে শব্দটি বাদ পড়ে কেবল সিংহ ও আসন শব্দদ্বয় অবশিষ্ট রয়ে গেছে। আর সন্ধির প্রয়োগে শব্দদ্বয় একত্রে মিলিত হয়েছে: সিংহ + আসন= সিংহাসন।

সমাসের অঙ্গ

সমাসের অঙ্গগুলো হলো একক-সমাস গঠনের উপাদান —

সমস্যমান পদ: প্রত্যেকটি পদ যার মিলনে সমাস গঠিত হয়।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মতে,

“যে সকল পদ লইয়া সমাস হয়, তাহাদের প্রত্যেকটিকে সমান সমান পদ বলে।”

সমস্তপদ সাধারণত এক শব্দ হিসেবে লেখা হয়। তবে কখনো কখনো “উচ্চারণ বা অর্থের বিভ্রাপ্তি ঘটার আশঙ্কায়” পূর্বপদ ও পরপদের মাঝে হাইফেন (-) বসে।

পূর্বপদ: সমস্যমান পদের মধ্যে অবস্থিত প্রথম পদটি।

পরপদ বা উত্তরপদ: সমস্যমান পদের মধ্যে অবস্থিত পরবর্তী পদটি।

মধ্যপদ: পূর্বপদ ও পরপদের মধ্য অবস্থিত “অতিরিক্ত” কোনো পদ।

ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহ বাক্য: অর্থ– বিস্তৃত বাক্য বা বিশ্লেষণকারী বাক্য।[৭] সমাসবদ্ধ পদগুলোকে বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদ বা পদসমষ্টি। সমস্যমান পদগুলোই একত্রিত হয়ে ব্যাসবাক্য গঠন করে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মতে, “সমস্ত পদকে ভাঙ্গিয়া যে বাক্যাংশ করা হয়, তাহাকে সমাসবাক্য বা ব্যাসবাক্য বলা হয়।”

সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ: সমাসের মাধ্যমে ব্যাসবাক্য থেকে সমস্যমান পদগুলি মিলিত হয়ে গঠিত সমাসনিষ্পন্ন একটি পদ।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে, “সমাসযুক্ত পদের নাম সমস্ত পদ।”

সিংহ চিহ্নিত যে আসন= সিংহাসন

প্রকারভেদ

প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণে সমাস ছয় প্রকার: দ্বন্দ্ব, দ্বিগু, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব সমাস।[১][২][৩][৪][৬][৭][১২] তবে আধুনিক বাংলা ব্যাকরণে সমাস চার প্রকার: দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ ও বহুব্রীহি সমাস;[৩][৫] এক্ষেত্রে বর্তমানে অব্যয়ীভাব সমাসকে তৎপুরুষ সমাস এবং দ্বিগু সমাসকে কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া আরো কিছু অপ্রধান সমাসও আছে: প্রাদি, নিত্য, অলুক, উপপদ ইত্যাদি।

দ্বন্দ্ব সমাস

মূল নিবন্ধ: দ্বন্দ্ব সমাস

যে সমাসে প্রতিটি সমস্যমান পদের অর্থের সমান প্রাধান্য থাকে এবং ব্যাসবাক্যে একটি সংযোজক অব্যয় (কখনো বিয়োজক) দ্বারা যুক্ত থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।

দ্বন্দ্ব সমাস নয় প্রকার:

১। সমার্থক দ্বন্দ্ব: কাজ ও কর্ম = কাজ-কর্ম, হাট-বাজার, ঘর-দুয়ার, কল-কারখানা, খাতা-পত্র

২। বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব: দিন ও রাত = দিন-রাত, জমা-খরচ, ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো, লাভ-লোকসান

৩। বিকল্পর্থক দ্বন্দ্ব: হার অথবা জিৎ = হার-জিৎ

৪। সমাহার দ্বন্দ্ব: দুধ ও কলা = দুধ-কলা

৫। মিলনার্থক দ্বন্দ্ব: চাল ও ডাল = চাল-ডাল, মা-বাপ, মাসি-পিসি, জ্বিন-পরি, চা-বিস্কুট

৬। অলুক দ্বন্দ্ব: কাগজে ও কলমে = কাগজে-কলমে

৭। বহুপদী দ্বন্দ্ব: রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ = রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ

৮। একশেষ দ্বন্দ্ব: তুমি, সে ও আমি = আমরা

৯। অনুকার দ্বন্দ্ব: কাজ ও টাজ= কাজটাজ

কর্মধারয় সমাস

মূল নিবন্ধ: কর্মধারয় সমাস

বিশেষ্যের সাথে বিশেষণের সমাসকে কর্মধারয় সমাস বলে। যথা: নীল যে উৎপল = নীলোৎপল। কর্মধারয় সমাসে উত্তর পদের অর্থ প্রধান হয়।

কর্মধারয় সমাস প্রধানত পাঁচ প্রকার। যথা:

(১) সাধারণ কর্মধারয়

বিশেষণ ও বিশেষ‍্য, বিশেষ‍্য ও বিশেষ‍্য অথবা বিশেষণ ও বিশেষণ পদের মধ‍্যে এই সমাস হয়ে থাকে। যেমন, নীল যে আকাশ = নীলাকাশ।

(২) মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস

কর্মধারয় সমাসে কোন কোন স্থানে মধ্যপদের লোপ হয়। সেজন্যেই একে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। যথা: গাড়ি রাখবার বারান্দা = গাড়িবারান্দা। এখানে ‘রাখবার’ মধ্যপদের লোপ হয়েছে।

(৩) উপমিত কর্মধারয় সমাস

সমান ধর্মবাচক পদের প্রয়োগ না থাকলে উপমেয় ও উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: মুখ চন্দ্রসদৃশ = মুখচন্দ্র।

(৪) রূপক কর্মধারয় সমাস

উপমেয় পদে উপমানের আরোপ করে যে সমাস হয়, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এতে উপমেয় পদে রূপ শব্দের যোগ থাকে। যেমন: বিদ্যারূপ ধন = বিদ্যাধন। এখানে ‘রূপ’ শব্দের যোগ রয়েছে।

(৫) উপমান কর্মধারয় সমাস

উপমানবাচক পদের সাথে সমান ধর্মবাচক পদের মিলনে যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: শশের (খরগোশের) ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত।

তৎপুরুষ সমাস

মূল নিবন্ধ: তৎপুরুষ সমাস

দ্বিতীয়াদি বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। এতে উত্তরপদের অর্থ প্রাধান্য থাকে। যেমনঃ লবণ দ্বারা যুক্ত = লবণাক্ত।

“‘তৎপুরুষ”‘ শব্দটির অর্থ হল “তার পুরুষ”। তার পুরুষ এই শব্দ গুলির একপদীকরণে তৎপুরুষ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পূর্ব পদ থেকে সম্বন্ধ পদের বিভক্তি ‘র’ লোপ পেয়েছে ও উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। এইভাবে এই সমাসের অধিকাংশ উদাহরণে পূর্ব পদের বিভক্তি লোপ পায় ও উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য থাকে এবং তৎপুরুষ শব্দটি হল এই রীতিতে নিষ্পন্ন সমাষের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। তাই উদাহরণের নামেই এর সাধারণ নামকরণ করা হয়েছে তৎপুরুষ সমাস।

তৎপুরুষ সমাস ছয় প্রকার। যথা:

(১) দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ

দ্বিতীয়া-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ স্বর্গকে গত = স্বর্গগত।

(২) তৃতীয়া-তৎপুরুষ

তৃতীয়া-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে তৃতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ রজ্জু দ্বারা বন্ধ = রজ্জুবন্ধ।

(৩) চতুর্থী-তৎপুরুষ

চতুর্থী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে চতুর্থী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ যজ্ঞের নিমিত্ত ভূমি = যজ্ঞভূমি।

(৪) পঞ্চমী-তৎপুরুষ

পঞ্চমী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে পঞ্চমী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ মুখ হইতে ভ্রষ্ট = মুখভ্রষ্ট।

(৫) ষষ্ঠী-তৎপুরুষ

ষষ্ঠী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে ষষ্ঠী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ দীনের বন্ধু = দীনবন্ধু।

(৬) সপ্তমী-তৎপুরুষ

সপ্তমী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে সপ্তমী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ দিবাতে নিদ্রা = দিবানিদ্রা।

(৭) উপসর্গ-তৎপুরুষ সমাস (= অব্যয়ীভাব)

অনুবাদ অব্যয় পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয় এবং যাতে পূর্ব পদের অর্থেরই প্রাধান্য থাকে, তাকে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বা অব্যয়ীভাব সমাস বলে। যেমনঃ আত্মাকে অধি (অধিকার করিয়া) = অধ্যাত্ম।

(৮) উপপদ-তৎপুরুষ সমাস

যে পদের পরবর্তী ক্রিয়ামূলের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয়, সে পদকে উপপদ বলে। কৃদন্ত পদের সাথে উপপদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: জলে চরে যা= জলচর, জল দেয় যা= জলদ, পঙ্কে জন্মে যা= পঙ্কজ ইত্যাদি।

এছাড়াও, নঞ্ অব্যয় পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে নঞ্তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ ন উক্ত = অনুক্ত।

বহুব্রীহি সমাস

মূল নিবন্ধ: বহুব্রীহি সমাস

যে সমাসের পূর্বপদ ও পরপদ কারো অর্থ প্রাধান্য পায় না, সমস্ত পদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।

প্রধানত বহুব্রীহি সমাস সাত প্রকার:

১। সমানাধিকরন বহুব্রীহি: দশানন—দশ আনন যার

২। ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি: পাপমতি– পাপে মতি যার

৩। মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি: বিড়ালোক্ষী– বিড়ালের অক্ষির মতো অক্ষি যার

৪। অলুক বহুব্রীহি: মুখেভাত– মুখে ভাত দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে।

৫। ব্যাতিহার বহুব্রীহি: লাঠালাঠি– লাঠিতে লাঠিতে যে লড়াই।

৬। না বহুব্রীহি: নির্বাক– নেই(ন) বাক যার।

৭। সহার্থক বহুব্রীহি: সবাক– বাকের সহিত বর্তমান

দ্বিগু সমাস

মূল নিবন্ধ: দ্বিগু সমাস

পূর্ব পদে সংখ্যাবাচক শব্দ বসে সমাহার বা সমষ্টি বা মিলন অর্থে সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয়, তাকে দ্বিগু সমাস বলে।

তদ্ধিতার্থে; যথাঃ পঞ্চ (পাঁচটি) গো দ্বারা ক্রীত = পঞ্চগু।

উত্তরপদ পরে, যথাঃ পঞ্চ হস্ত প্রমাণ ইহার = পঞ্চহস্তপ্রমাণ। (এখানে প্রমাণ শব্দ উত্তরপদ পরে থাকায় পঞ্চ ও হস্ত এই দুই পদের দ্বিগু সমাস হয়েছে)।

সমাহারে; যথাঃ ত্রি (তিন) লোকের সমাহার = ত্রিলোক।

চৌ রাস্তার সমাহার= চৌরাস্তা

সে(তিন) তারের সমাহার= সেতারা

শত অব্দের সমাহার=শতাব্দী

ছয় ঋতুর সমাহার=ষড়রিতু

দ্বিগু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘দুটি গরু’ কিন্তু ব্যাকরণ সম্মত অর্থ হল ‘দুটি গরুর মূল্যে কেনা।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

অব্যয়ীভাব সমাস

মূল নিবন্ধ: অব্যয়ীভাব সমাস

অনুবাদ অব্যয় পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয় এবং যাতে পূর্ব পদের অর্থেরই প্রাধান্য থাকে, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। এই সমাসকে বর্তমানে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: আত্মাকে অধি (অধিকার করিয়া) = অধ্যাত্ম।

অন্যান্য সমাস

ছয়টি প্রধান সমাস ছাড়াও কয়েকটি অপ্রধান সমাস রয়েছে। যেমন: প্রাদি, নিত্য, অলুক, উপপদ ইত্যাদি। এসব সমাসের প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায় না। এজন্য এগুলোকে অপ্রধান মনে করা হয়।

নিত্য সমাস

যে সমাসে সমস্যমান পদ দ্বারা সমাস-বাক্য হয় না, অন্য পদের দ্বারা সমস্ত পদের অর্থ প্রকাশ করতে হয়, তাকে নিত্য সমাস বলে। তদর্থবাচক ব্যাখ্যামূলক শব্দ বা বাক্যাংশ যোগে এগুলোর অর্থ বিশদ করতে হয়। যেমন: কেবল তা = তন্মাত্র, অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর, কেবল দর্শন = দর্শনমাত্র, অন্য গৃহ = গৃহান্তর, (বিষাক্ত) কাল (যম) তুল্য (কাল বর্ণের নয়) সাপ = কালসাপ, তুমি আমি ও সে = আমরা, দুই এবং নব্বই = বিরানব্বই।

অলোপ সমাস

যে সমাসে সমস্যমান পদের বিভক্তি লোপ পায় না, তাকে অলোপ সমাস বলে। যেমন: দুধে-ভাতে, জলে-স্থলে, দেশে-বিদেশে, হাতে-কলমে, ঘোড়ার ডিম, মাটির মানুষ, মামার বাড়ি, গায়ে পড়া, গায়ে হলুদ, হাতেখড়ি, মুখে-ভাত,কানে-কলম ইত্যাদি।

উপপদ সমাস

কৃদন্ত-পদের পূর্বে যে পদ থাকে, তাকে উপপদ বলে এবং উপপদের সাথে কৃদন্ত-পদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ সমাস বলে। যেমন: কুম্ভ করে যে = কুম্ভকার।

প্রাদি সমাস

প্র,পরা প্রভৃতি ২০টি উপসর্গের সাথে কৃৎ প্রত্যয়সাধিত বিশেষ্য পদের সমাস হলে, তাকে প্রাদি সমাস বলে। যেমন: সম্ (সম্যক্) যে আদর = সমাদর, প্র (প্রকৃষ্ট) যে বচন = প্রবচন, পরি (চতুর্দিকে) যে ভ্রমণ = পরিভ্রমণ, অনুতে (পশ্চাতে) যে তাপ = অনুতাপ, প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) ভাত (আলোকিত) = প্রভাত, প্র (প্রকৃষ্ট রূপে) গতি = প্রগতি ইত্যাদি, প্রদর্শন=প্রকৃত রুপে দর্শন, প্রনাম=প্রত্যয় দ্বারা নাম।

বাক্যাশ্রয়ী সমাস

যে সমাসে সমাসবদ্ধ পদগুলি একমাত্রায় লেখা হয় না এমনকি সবসময় পদসংযোজক চিহ্ন দ্বারাও যুক্ত করে লেখা হয় না – বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত এই সমাসকে বলা হয় বাক্যাশ্রয়ী সমাস। যেমন ; ‘বসে-আঁকো-প্রতিযোগিতা’, ‘সব-পেয়েছির-দেশ’, ‘রক্ত-দান-শিবির’ ইত্যাদি ।

গুরুত্বপূর্ণ ৫০টি সমাস

ক্র. সমাস শব্দ সমাসের নাম সমস্তপদ ব্যাসবাক্য (উদাহরণ) সমাসের পূর্ণরূপ
শিক্ষার্থী তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত শিক্ষা + আর্থী শিক্ষ + আর্থী
নদীতীর তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত নদী + তীর নদী + তীর
পদ্মফুল তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত পদ্ম + ফুল পদ্ম + ফুল
বিদ্যালয় তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত বিদ্যা + আলয় বিদ্যা + আলয়
গৃহকর্ম তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত গৃহ + কর্ম গৃহ + কর্ম
রাজপুত্র তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত রাজ + পুত্র রাজ + পুত্র
সন্তান তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত স্নাত + তান স্নাত + তান
বীজবৃক্ষ তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত বীজ + বৃক্ষ বীজ + বৃক্ষ
পথিক তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত পথ + ইক পথ + ইক
১০ গ্রন্থাগার তৎপুরুষ সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত গ্রন্থ + আগার গ্রন্থ + আগার
১১ বাবা-মা দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ বাবা + মা বাবা + মা
১২ দিন-রাত দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ দিন + রাত দিন + রাত
১৩ সুখ-দুঃখ দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ সুখ + দুঃখ সুখ + দুঃখ
১৪ বন্ধু-শত্রু দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ বন্ধু + শত্রু বন্ধু + শত্রু
১৫ চাঁদ-সূর্য দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ চাঁদ + সূর্য চাঁদ + সূর্য
১৬ শীত-গ্রীষ্ম দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ শীত + গ্রীষ্ম শীত + গ্রীষ্ম
১৭ ছেলে-মেয়ে দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ ছেলে + মেয়ে ছেলে + মেয়ে
১৮ সোনা-রূপা দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ সোনা + রূপা সোনা + রূপা
১৯ কৃষক-মজুর দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ কৃষক + মজুর কৃষক + মজুর
২০ নদী-সমুদ্র দ্বন্দ্ব সমাস সমপদ + সমপদ নদী + সমুদ্র নদী + সমুদ্র
২১ চন্দ্রবদন তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত চন্দ্র + বদন চন্দ্র + বদন
২২ মহাকাব্য তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত মহা + কাব্য মহা + কাব্য
২৩ দেবদাস তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত দেব + দাস দেব + দাস
২৪ লোকনাথ তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত লোক + নাথ লোক + নাথ
২৫ হংসপদ্ম তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত হংস + পদ্ম হংস + পদ্ম
২৬ বালকেশ্বর তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত বালক + ঈশ্বর বালক + ঈশ্বর
২৬ শ্রীবৃদ্ধি তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত শ্রী + বৃদ্ধি শ্রী + বৃদ্ধি
২৭ নারায়ণ তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত নর + আয়ণ নর + আয়ণ
২৮ শশধর তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত শশ + ধর শশ + ধর
২৯ মধুমালা তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত মধু + মালা মধু + মালা
৩০ হিরণ্যপদ তৎসম (বহুব্রীহি) সমাস নির্ধারক + নির্ধারিত হিরণ্য + পদ হিরণ্য + পদ
৩১ অন্তরীক্ষ অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অন্তর + আকাশ অন্তর + আকাশ
৩২ অধিকার অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অধি + কার অধি + কার
৩৩ অবশেষ অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অব + শেষ অব + শেষ
৩৪ অপরাহ্ন অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অপ + আহ্ন অপ + আহ্ন
৩৫ অতীত অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অত + ইত অত + ইত
৩৬ অনন্ত অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অন + অন্ত অন + অন্ত
৩৭ অনুতপ্ত অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অনু + তপ্ত অনু + তপ্ত
৩৮ অবিরাম অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অব + ইরম অব + ইরম
৩৯ অন্বেষণ অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অনু + শিক্ষা অনু + শিক্ষা
৪০ অপার্থিব অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অপ + আর্থিব অপ + আর্থিব
৪১ অন্তরঙ্গ অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অন্তর + অঙ্গ অন্তর + অঙ্গ
৪২ অধঃপতন অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অধঃ + পতন অধঃ + পতন
৪৩ অনুসন্ধান অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অনুসন্ধান অনুসন্ধান
৪৪ অবলম্বন অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অব + লম্বন অব + লম্বন
৪৫ অধিকারিতা অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অধি + কারিতা অধি + কারিতা
৪৬ অনন্তকাল অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অনন্ত + কাল অনন্ত + কাল
৪৭ অভ্যর্থনা অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অভ্য + র্থনা অভ্য + র্থনা
৪৮ অবলোকন অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অব + লোকন অব + লোকন
৪৯ অবসান অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অব + সান অব + সান
৫০ অনুগ্রহ অব্যয়ীভব সমাস অব্যয় + পদ অনু + গ্রহ অনু + গ্রহ

ফোটনোট:

  • সমস্তপদ অর্থাৎ সমাস গঠনের উপাদান শব্দগুলোকে বলা হয় সমস্তপদ।
  • ব্যাসবাক্য হলো সেই দুই বা ততোধিক শব্দের সমষ্টি যেগুলো একসঙ্গে মিলেই সমাস গঠন করে।
  • সমাসের প্রকারভেদ প্রধানত চারটি হলেও আরও উপশাখা ও সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে।
  • অনেক সমাস উদাহরণ বাংলা সাহিত্য ও দৈনন্দিন জীবনে প্রচুর ব্যবহৃত হয়।

বাংলা ব্যাকরণে সমাসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, প্রকারভেদ, সমস্তপদ ও ৫০টি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণসহ সহজ ও সম্পূর্ণ গাইড। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য উপযোগী।

বাংলা ব্যাকরণে সমাসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, প্রকারভেদ, সমস্তপদ ও ৫০টি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণসহ সহজ ও সম্পূর্ণ গাইড। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য উপযোগী।

https://www.munshiacademy.com/সমাস-প্রকারভেদসহ-বিস্তা/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *