শামসুজ্জামান খান : জীবন ও কর্ম
ভূমিকা
শামসুজ্জামান খান (২৯ ডিসেম্বর ১৯৪০ – ১৪ এপ্রিল ২০২১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, গবেষক ও লোককাহিনিবিদ। তিনি দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, গবেষণা, প্রশাসন ও সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর সম্পাদিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা (৬৪ খণ্ড) ও বাংলাদেশের ফোকলোর সংগ্রহমালা (১১৪ খণ্ড), যা বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি গবেষণায় অমূল্য অবদান হিসেবে বিবেচিত। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
শামসুজ্জামান খান ১৯৪০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইরের চারিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দু’বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে তিনি মা ও দাদির কাছে বড় হন। তাঁর পিতা এম. আর. খান কলকাতায় সরকারি দপ্তরে অনুবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
কর্মজীবন
শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণা ও লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এছাড়া ১৯৯৯–২০০১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
২০০৯ সালের ২৪ মে তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং টানা তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন (২০০৯–২০১৮)। এরপর তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান।
গবেষণা ও রচনা
লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষণায় শামসুজ্জামান খানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সম্পাদিত দুটি প্রধান কাজ হলো:
- বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা (৬৪ খণ্ড)
- বাংলাদেশের ফোকলোর সংগ্রহমালা (১১৪ খণ্ড)
এছাড়া তিনি শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ ও ঐতিহাসিক রচনাতেও অবদান রেখেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রয়েছে:
- দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ (শিশু সাহিত্য)
- বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা (প্রবন্ধ)
পুরস্কার ও সম্মাননা
তাঁর সাহিত্য ও গবেষণা অবদানের জন্য শামসুজ্জামান খান বহু জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৭)
- কালুশাহ পুরস্কার (১৯৮৭)
- দীনেশচন্দ্র সেন ফোকলোর পুরস্কার (১৯৯৪)
- আব্দুর রউফ চৌধুরি স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৮)
- দেওয়ান গোলাম মোর্তজা পুরস্কার (১৯৯৯)
- শহীদ সোহরাওয়ার্দী জাতীয় গবেষণা পুরস্কার (২০০১)
- মীর মশাররফ হোসেন স্বর্ণপদক (২০০৪)
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০০১)
- একুশে পদক (২০০৯)
- স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (২০১৭)
সমালোচনা
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজনের অনুমতি দেওয়ায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। অনেকেই মনে করেছিলেন, এটি বাংলা একাডেমির নীতি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সমকালীন প্রাবন্ধিক সলিমুল্লাহ খানও তাঁর প্রশাসনিক ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন।
মৃত্যু
শামসুজ্জামান খান ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
উপসংহার
লোকসংস্কৃতি গবেষণা, সম্পাদনা, প্রবন্ধ ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের মাধ্যমে শামসুজ্জামান খান বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সম্পাদিত লোকসংস্কৃতি গ্রন্থমালা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য ঐতিহ্য হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন একাধারে গবেষক, শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসেবী—বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে যাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।