যতিচিহ্ন (বিরামচিহ্ন) : বাংলা ভাষার অপরিহার্য সাংকেতিক চিহ্ন
যতিচিহ্ন বা বিরামচিহ্ন হলো সেইসব সাংকেতিক চিহ্ন, যেগুলো বাক্যের ভাব, অর্থ ও আবেগ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। যেভাবে আমরা কথা বলার সময় বিরতি দেই, আবেগ বা প্রশ্ন প্রকাশ করি, ঠিক তেমনিভাবে লেখায়ও এসব চিহ্ন ব্যবহৃত হয় যাতে বাক্যের অর্থ স্পষ্ট ও সঠিকভাবে বুঝানো যায়।
বাংলা ভাষায় মোট প্রায় ২০ ধরনের যতিচিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে,
- বাক্যশেষে ব্যবহৃত যতিচিহ্ন: ৪টি
- বাক্যের ভিতরে ব্যবহৃত যতিচিহ্ন: ১০টি
- বাক্যের আগে বা পরে ব্যবহৃত যতিচিহ্ন: ৬টি
যতিচিহ্নের নাম, চিহ্ন ও ব্যবহার
যতিচিহ্নের নাম | আকৃতি | ব্যবহার ও বিরতি কাল |
---|---|---|
কমা (পাদচ্ছেদ) | , | স্বল্প বিরতি; একাধিক পদ তালিকা বা সম্বোধনে ব্যবহৃত |
সেমিকোলন (অর্ধচ্ছেদ) | ; | কমার থেকে বেশি বিরতি, কিন্তু পূর্ণচ্ছেদের চেয়ে কম |
দাঁড়ি (পূর্ণচ্ছেদ) | । | বাক্যের সমাপ্তি নির্দেশ করে |
প্রশ্নবোধক চিহ্ন | ? | প্রশ্নবোধক বাক্যের শেষে ব্যবহৃত |
বিস্ময়চিহ্ন | ! | বিস্ময়, সম্বোধন, আবেগ প্রকাশে ব্যবহৃত |
কোলন | : | উদাহরণ, ব্যাখ্যা বা অবতারণায় ব্যবহৃত |
ড্যাশ | — | পৃথক ভাবের সংযোগ বা সংক্ষিপ্ত বিরতি প্রকাশে |
কোলন-ড্যাশ | :- | পূর্বে উদাহরণ সূচক; বর্তমানে কম ব্যবহৃত |
হাইফেন (সংযোগচিহ্ন) | – | সমাস বা সংযুক্ত শব্দ আলাদা করতে ব্যবহৃত |
ইলেক (লোপচিহ্ন) | ’ | বিলুপ্ত বর্ণের পরিবর্তে ব্যবহৃত |
একক উদ্ধৃতি চিহ্ন | ‘ ‘ | প্রত্যক্ষ উক্তি বা উদ্ধৃতির জন্য |
যুগল উদ্ধৃতি চিহ্ন | “ ” | উদ্ধৃতির ভিতরে উদ্ধৃতি বা সাহিত্যিক শিরোনামের জন্য |
বন্ধনী (ব্র্যাকেট) | ( ), { }, [ ] | ব্যাখ্যা বা অতিরিক্ত তথ্য প্রদানে ব্যবহৃত |
ধাতু দ্যোতক চিহ্ন | √ | ধাতু বা রসায়নে ব্যবহৃত চিহ্ন |
পরবর্তী রূপবোধক চিহ্ন | < | পরবর্তী নির্দেশ করে |
পূর্ববর্তী রূপবোধক চিহ্ন | > | পূর্ববর্তী নির্দেশ করে |
সমান চিহ্ন | = | সমতা বা সমানতা নির্দেশ করে |
বর্জন চিহ্ন | … | বর্জিত অংশ বা অব্যক্ত নির্দেশ করে |
সংক্ষেপণ চিহ্ন | . | শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপের শেষে ব্যবহৃত |
বিকল্প চিহ্ন | / | বিকল্প শব্দ বা ধারণা প্রকাশে ব্যবহৃত |
যতিচিহ্নের বিশদ ব্যবহার
১. কমা (,)
- বাক্য পড়ার সময় স্বল্প বিরতি দিতে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
সুখ চাও, সুখ পাবে পরিশ্রমে। - একাধিক বিশেষ্য বা বিশেষণ একত্রে থাকলে প্রত্যেকটির পরে কমা বসে (শেষ বাদে)।
উদাহরণ:
সুখ, দুঃখ, আশা, নৈরাশ্য একই মালিকার পুষ্প। - সম্বোধনের পর কমা বসে।
উদাহরণ:
রশিদ, এখানে এসো। - উদ্ধৃতি চিহ্নের আগে কমা ব্যবহার হয়।
উদাহরণ:
সে বলল, “আমি আসব।” - তারিখ বা ঠিকানায় বার ও মাসের পর কমা লাগে।
উদাহরণ:
১৬ই পৌষ, বুধবার, ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ।
২. সেমিকোলন (;)
- কমা অপেক্ষা বেশি বিরতির প্রয়োজন হলে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
সে এসেছিল; কিন্তু কথা বলেনি।
৩. দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ (।)
- বাক্যের সমাপ্তি নির্দেশ করে।
উদাহরণ:
আমি আজ স্কুলে গিয়েছিলাম।
৪. প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?)
- প্রশ্নবোধক বাক্যের শেষে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
তুমি কি আসবে?
৫. বিস্ময়চিহ্ন (!)
- বিস্ময়, সম্বোধন বা আবেগ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
অসাধারণ! তুমি এভাবে করতে পারো!
৬. কোলন (:)
- উদাহরণ বা ব্যাখ্যা দিতে ব্যবহৃত।
উদাহরণ:
সে বলল: “আমি যাব।”
৭. ড্যাশ (—)
- পৃথক ভাবের সংযোগ বা বিরতি দেখাতে ব্যবহৃত।
উদাহরণ:
সে বলল—তবে মনে রেখো—যথাসময়ে আসবে।
৮. হাইফেন (-)
- সমাস বা সংযুক্ত শব্দ আলাদা করতে ব্যবহৃত।
উদাহরণ:
রাজপথ-চলতি গাড়ি থেমে গেল।
৯. লোপচিহ্ন (’)
- বিলুপ্ত বর্ণের পরিবর্তে ব্যবহৃত।
উদাহরণ:
সে বলল, “আমি ’যাব।”
১০. উদ্ধৃতি চিহ্ন (‘ ‘, “ ”)
- প্রত্যক্ষ উক্তি বা উদ্ধৃতির জন্য।
উদাহরণ:
তিনি বললেন, “আজকের পড়া সহজ ছিল।”
১১. বন্ধনী ( (), {}, [] )
- অতিরিক্ত তথ্য বা ব্যাখ্যার জন্য।
উদাহরণ:
সে স্কুলে গিয়েছিল (কিন্তু পড়াশোনা করেনি)।
১২. বিকল্প চিহ্ন (/)
- বিকল্প অর্থে বা “অথবা” বোঝাতে ব্যবহৃত।
উদাহরণ:
সময়মত সালাত/নামাজ আদায় করুন।
প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
আমরা কথায় থেমে থেমে, আবেগ বা ভাব প্রকাশ করে কথা বলি। লেখায় সেইসব বিরতি ও আবেগ প্রকাশের জন্য যতিচিহ্ন অপরিহার্য। সঠিক যতিচিহ্ন ব্যবহার না করলে বাক্যের অর্থ বিভ্রাট ঘটে। সুতরাং ভাষার স্বচ্ছতা, শুদ্ধতা ও ব্যাকরণগত সঠিকতার জন্য যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য।
উল্লেখ্য: বাংলা ভাষায় যতিচিহ্নের সঠিক প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও এর ওপর জোর দেওয়া হয়।
https://www.munshiacademy.com/যতিচিহ্ন-বা-বিরামচিহ্ন/