মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা : আবিষ্কার ও কর্মযজ্ঞ

📘 ভূমিকা
বাঙালির বিজ্ঞান-মনস্কতা, শিক্ষা-চেতনা এবং স্বকীয় চিন্তাশীলতা বিকাশে যাঁরা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন বিশ্বখ্যাত রসায়নবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সমাজসংস্কারক। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ ও নিজস্ব গবেষণা বাংলাদেশের বিজ্ঞান চর্চায় এক নতুন মাত্রা এনে দেয়।
🧒 জন্ম ও শৈশব
ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদার জন্ম ১৯০০ সালের ৮ মে, বৃহত্তর যশোর জেলার তৎকালীন পার্বতীপুর গ্রামে (বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলা)। শৈশবেই মেধার পরিচয় দেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল জৈব রসায়ন (Organic Chemistry)।
🔬 গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক কর্মযজ্ঞ
ড. কুদরাত-ই-খুদা একজন প্রথিতযশা রসায়নবিদ ছিলেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেশীয় সম্পদের ওপর ভিত্তি করে, যা ছিল একান্ত দেশপ্রেমিক ও বাস্তবভিত্তিক। তাঁর গবেষণার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক নিম্নরূপ:
✅ ১. দেশীয় কাঁচামাল থেকে রাসায়নিক উৎপাদন
তিনি জুট, আখের ব্যাগাস, খৈল, ধানের তুষ প্রভৃতি দেশীয় সম্পদ থেকে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ও কসমেটিকস পণ্য তৈরির উপায় উদ্ভাবন করেন। এর মাধ্যমে বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীলতার দিক নির্দেশ করেন।
✅ ২. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ল্যাব ব্যবস্থাপনা
পাকিস্তান আমলে তিনি করাচিতে সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়।
✅ ৩. বিজ্ঞান চর্চার ভাষা হিসাবে বাংলা
তিনি বিশ্বাস করতেন, “শিক্ষা ও বিজ্ঞান নিজের মাতৃভাষায় না হলে গণমানুষের কাছে তা পৌঁছায় না।” তাঁর নেতৃত্বেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানপাঠ্য পুস্তক রচিত ও অনূদিত হয়।
🏛️ শিক্ষা সংস্কার ও নেতৃত্ব
স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণা নীতিমালা প্রণয়নে ড. কুদরাত-ই-খুদার ভূমিকা অপরিসীম।
✅ ১. ১৯৭৪ সালের কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে শিক্ষা কমিশনের প্রধান করেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত “কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন” ছিল বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি। এ কমিশন সাধারণ শিক্ষাকে প্রযুক্তিমুখী ও কর্মমুখী করে গড়ে তোলার সুপারিশ করে।
✅ ২. বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (BCSIR)
তিনি ছিলেন BCSIR-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশীয় শিল্প, কৃষি, ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ভিত্তি স্থাপন হয়।
🏅 সম্মাননা ও স্বীকৃতি
ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা পেয়েছেন বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৬)
- সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (পাকিস্তান)
- বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রি
👨🏫 দার্শনিক ভাবনা ও আদর্শ
“শিক্ষা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, উৎপাদনমুখী ও জনকল্যাণকামী” – ড. কুদরাত-ই-খুদা
তিনি সবসময় বাস্তববাদী, গণমুখী ও মানবিক শিক্ষার পক্ষে ছিলেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞান শিক্ষা কেবল পরীক্ষার জন্য নয়, বরং তা হতে হবে জীবনের প্রয়োজনে ব্যবহারের উপযোগী।
🕯️ মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
এই মহান বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদের মৃত্যু হয় ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর, ঢাকায়। তাঁর অবদান আজও বাংলাদেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞান নীতিতে অনুপ্রেরণার আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে।
📚 উপসংহার
ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা কেবল একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী চিন্তাবিদ ও দেশপ্রেমিক। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মযজ্ঞ আজও বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীলতা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। আমাদের উচিত তাঁর আদর্শ ও দর্শনকে অনুসরণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্ভাবনী ও মানবিক শিক্ষার পথে পরিচালিত করা