জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
(Kazi Nazrul Islam: The National Poet of Bangladesh)

ভূমিকা
কাজী নজরুল ইসলাম — এই নামের সাথেই জড়িয়ে আছে এক বিদ্রোহী, এক কবি, এক সংগীতজ্ঞ, এক সৈনিক, এক প্রেমিক এবং সর্বোপরি এক মহান মানবতাবাদীর পরিচয়। যিনি কেবল কবিতার পঙ্ক্তিতে নয়, ইতিহাসের পাতায় তাঁর চেতনার ছাপ রেখে গেছেন।
তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি, যাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানবতার জয়গান এবং প্রেম ও সৌন্দর্যের চিরন্তন অভিব্যক্তি।
এই প্রবন্ধে আমরা তাঁর জীবন, সাহিত্যকর্ম, সমাজদর্শন, সংগীত, রাজনৈতিক ভাবনা ও উত্তরাধিকার বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব।
জন্ম ও শৈশব
কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাযারের খাদেম। মা জাহেদা খাতুন ছিলেন সহজ-সরল, ধর্মপরায়ণ নারী।
বাল্যকাল থেকেই নজরুলের জীবন ছিল সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জে ভরা। পিতার অকালমৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। স্কুলে পড়ার পাশাপাশি রুটির দোকানে কাজ করা, মসজিদে মোয়াজ্জিনের কাজ করা, লেটো দলে যোগ দেওয়া — এসব জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে মানুষ ও সমাজকে গভীরভাবে চিনতে শিখিয়েছিল।
লেটো দল ও সাহিত্যজগতের সূচনা
তরুণ বয়সে নজরুল “লেটো গান”-এর দলে কাজ করার সময় থেকেই কবিতা, গান ও নাটকের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন। পরবর্তীকালে তিনি মক্তবে শিক্ষকতা ও স্থানীয় নাট্যদলে অভিনয় করতেন।
সেই সময়েই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার বীজ রোপিত হয়। লেটো গানের ছন্দ, রাগ-রাগিণী, গল্প ও গদ্যগুচ্ছের ধারায় নজরুল আত্মপ্রকাশ করেন এক নবচেতনার কবি হিসেবে।
সেনাবাহিনীতে যোগদান ও রাজনৈতিক চেতনা
১৯১৭ সালে নজরুল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং করাচি সেনানিবাসে অবস্থানকালে তাঁর সাহিত্যচর্চা নতুন মাত্রা পায়। সৈনিকজীবনে তিনি সৈন্যদের অবস্থা, জাতীয় রাজনীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। এই সময়েই তাঁর লেখা “বিদ্রোহী”, “কামাল পাশা” প্রভৃতি কবিতা ভারতীয় উপমহাদেশে আলোড়ন তোলে।
সাহিত্যকর্ম ও ভাবধারা
নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এমন একজন কবি যিনি একাধারে বিদ্রোহ, প্রেম, প্রকৃতি, ধর্ম, সাম্য, মানবতা ও আধ্যাত্মিকতা—সবকিছুই নিজের সাহিত্যকর্মে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
১. বিদ্রোহ ও মুক্তির বাণী:
নজরুলের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিপ্লব ও বিদ্রোহের আহ্বান। তাঁর কবিতা শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক।
👉 “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন,
আমি চিরদ্রোহী, আমি মহামানব — ইতিহাস করিছে যার রচন!”
— বিদ্রোহী (১৯২২)
তিনি শুধু ব্যক্তিগত বা আবেগগত বিদ্রোহে বিশ্বাস করতেন না, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহে বিশ্বাসী ছিলেন।
২. সাম্যবাদ ও মানবতা:
নজরুল ছিলেন এক অকৃত্রিম মানবতাবাদী। ধর্ম, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অসীম।
👉 “গাহি সাম্যের গান —
যেথা আসিবে ধর্ম, জাতি, বর্ণ ভেদভান…”
তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় বিশ্বমানবতার দৃঢ় ঘোষণা ছিল, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
৩. প্রেম ও সৌন্দর্যচর্চা:
প্রেম-ভালবাসার ব্যাপারেও নজরুল ছিলেন সাহসী ও উদার। তাঁর কবিতায় প্রেম কখনো প্রেয়সীর, কখনো স্বদেশের, আবার কখনো মানবতার রূপে প্রকাশ পায়।
👉 “ভালোবাসা ভালোবেসে ভরেছি ধরণী,
তুমি আমার জীবনের রাণী।”
৪. ধর্মীয় ভাবধারা ও সহনশীলতা:
নজরুল ইসলাম ইসলামী ভাবধারার কবি হয়েও হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মসহ সকল ধর্মের মধ্যে মিল ও সহনশীলতা খুঁজে পেয়েছেন।
তাঁর গানে রাম, শিব, কালী, কৃষ্ণ যেমন আছে, তেমনি মুহাম্মদ (স.), আল্লাহ ও ইসলামের মহিমাও রয়েছে।
👉 “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।”
নজরুল সংগীত: সুরে বিদ্রোহ, প্রেম ও ভক্তি
নজরুল ছিলেন একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ, গীতিকার ও সুরকার। বাংলা গানে নজরুলের অবদান এতটাই বৈচিত্র্যময় যে তাঁকে বাংলা গানের ধারায় একটি স্বতন্ত্র ধারার প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় — “নজরুল সংগীত”।
তাঁর রচনায় প্রায় ৪০০০-এর বেশি গান রয়েছে, যার মধ্যে ইসলামী সংগীত, শ্যামা সংগীত, প্রেমগীতি, রাগাশ্রিত গান, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধক গান প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত।
বিখ্যাত নজরুল সংগীত:
- চল চল চল, উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল…
- কারার ঐ লৌহ কপাট…
- ভাঙার গান গাইরে আজি ভাঙার গান…
- মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম…
- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে…
- পথ চলিতে যদি চাহি না ফিরিতে…
সাহিত্যকর্মের তালিকা
কবিতা:
- অগ্নিবীণা (১৯২২)
- দোলনচাঁপা (১৯২৩)
- বিষের বাঁশি (১৯২৪)
- ভাঙ্গার গান (১৯২৪)
- ছায়ানট (১৯২৫)
- সঞ্চিতা (১৯২৫)
গল্প ও উপন্যাস:
- ব্যথার দান (গল্প)
- কুহেলিকা (উপন্যাস)
- বাঁধন হারা (উপন্যাস)
- রিক্তের বেদন (গল্প)
নাটক:
- আলেখ্য
- ঝিলিমিলি
- পুতুলের বিয়ে
রাজনীতি ও সাহিত্যসেনা নজরুল
নজরুল শুধু কবি ছিলেন না, ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক সাহিত্যসেনা।
তাঁর পত্রিকা ধূমকেতু (১৯২২) ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল।
👉 “আর রাজা-বাদশা মেরেছে দেশ,
দাও হুলিয়া! ধূমকেতু থেমে থাকবে না।”
এই লেখার জন্য তাঁকে ব্রিটিশ সরকার কারারুদ্ধ করে। জেলে বসেই তিনি রচনা করেন:
👉 “কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট…”
ব্যক্তিজীবন ও দাম্পত্য
নজরুল ১৯২৪ সালে প্রমীলা দেবীকে (নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের কন্যা) বিয়ে করেন। তাঁদের চার পুত্রসন্তান ছিল, তবে সবাই অল্প বয়সে মারা যান।
এই পারিবারিক শোক, দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক নিপীড়ন তাঁর জীবনে বড় ছাপ ফেলে।
অসুস্থতা ও নির্বাক জীবনের করুণ অধ্যায়
১৯৪২ সালে নজরুল দুরারোগ্য নিউরোলজিক্যাল রোগে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে আজীবনের জন্য নিঃশব্দ করে তোলে। চিকিৎসার জন্য কলকাতা, মুম্বাই এবং পরে বিদেশে পাঠানো হলেও নিরাময় হয়নি। প্রায় তিন দশক ধরে তিনি নিঃশব্দে জীবন কাটান।
বাংলাদেশে আগমন ও জাতীয় কবির স্বীকৃতি
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে নজরুলকে তাঁর পরিবারসহ বাংলাদেশে আনা হয়। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে রাখা হয়।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও দর্শন আজও বাংলাভাষী মানুষের চেতনাকে আলোড়িত করে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন:
- প্রতিবাদ করতে
- অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে
- মানবতাকে ভালোবাসতে
- প্রেমে জীবন সাজাতে
- ধর্মের নামে ভেদাভেদ না করতে
বাংলাদেশের সাহিত্য, সঙ্গীত, শিক্ষা, রাজনীতি — সর্বত্র নজরুলের চেতনার আলো স্পষ্ট। তাঁর বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য আর সাহসিকতা নতুন প্রজন্মকে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করছে।
উপসংহার
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন, তিনি এক মহাজাগরণের নাম। যিনি শব্দ দিয়ে শোষকের বিরুদ্ধে অস্ত্র বানিয়েছিলেন, যিনি গানে গানে প্রেম ও বিদ্রোহের সুর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণে।
তাঁর কবিতা ও গান আজও আমাদের সাহস জোগায়, প্রেমে ভাসায়, প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করে।
তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন— আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।