চেতনার অ্যালবাম – আবদুল হক

Spread the love

চেতনার অ্যালবাম – আবদুল হক

চেতনার এলবাম
চেতনার অ্যালবাম

 

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি 

বাংলা সাহিত্যপাঠ | – | NCTB 

 

ব্যক্তির চেতনা এই জীবনকালেই প্রথম আর শেষ কথা, কিন্তু সমগ্র মানবীয় চেতনা নয়। মানবীয় চেতনা ব্যক্তিমানুষের তুলনায় ছোটখাটো বিষয় নয়, বেশ দীর্ঘকালীন ব্যাপার। ব্যক্তির মধ্যে এই চেতনার প্রকাশ ঘটলেও মানবসমাজে এর ধারাবাহিক অবিচ্ছিন্নতা থেকে যায়। নানারূপ মহাজাগতিক কারণে একদিন গোটা মানবজাতির ই বিলুপ্তি ঘটবে; দৈব দুর্ঘটনায় অকালে না ঘটলেও স্বাভাবিকভাবে একদিন ঘটবেই, বৈজ্ঞানিকগণ এ-রকম কথা বলে থাকেন । এই পৃথিবীতে প্রাণীর এমন অনেক প্রজাতি ছিল যা এখন বিলুপ্ত; কোনো কোনো প্রজাতি কোটি বছর এবং তারও অধিককাল যাবৎ পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়িয়েছে তবু তারা আর নেই, কঙ্কাল দেখে তাদের অস্তিত্বের কথা জানতে হয়। একদিন তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তেমনি মানবজাতির ভাগ্যেও ঘটবে। কিন্তু এত দীর্ঘদিন পরে ঘটবে যে সেজন্য আজই মন খারাপ করে কোনো লাভ নেই । প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষেরই একদিন মৃত্যু ঘটবে আর সেটা সবাই জানে, কিন্তু সেজন্য কয়জন মানুষ মন খারাপ করে বসে থাকে? সীমাবদ্ধ কালের প্রাণী সে, যে-অর্থেই ধরা যাক : তথাপি অনন্তকালের কথা সে ভাবে। ভাবে, কেননা ওটা তার নিয়তির সঙ্গে বাঁধা।

এখানে আরও একটি কথা বলে রাখা ভালো । প্রবীণতার পথে ব্যক্তি-মানুষের যেমন একদিন স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, তেমনি প্রবীণতার পথে নবপ্রজাতিরও একদিন বিলোপ ঘটতে পারে; তবে অধুনা এটাও মনে হচ্ছে সে অকস্মাৎ আত্মহত্যাও করে বসতে পারে হাইড্রোজেন বোমা, নিউট্রন বোমা অথবা আরও বিধ্বংসী কোনো মারণাস্ত্র প্রয়োগে। অধুনা এই পথে মানবপ্রজাতির বিলোপের আশঙ্কা বিলক্ষণ বিদ্যমান, সেই আশঙ্কার কথা বাদ দিয়েই আমার এই প্রসঙ্গ ।

ধরা যাক, যেমন করেই হোক সব দুর্ঘটনা এড়িয়ে মানুষ বেঁচে-বর্তে রইল। কিন্তু তখন যে-সমস্যা দেখা দেবে তা হচ্ছে মানুষের বহুবিচিত্রমুখী জ্ঞানভাণ্ডারের সমন্বয় সাধন। মানুষ ক্রমাগত বিভিন্ন প্রকার জ্ঞান (শিল্প-সাহিত্যসহ) সৃষ্টি করে চলেছে । যে-কোনো বিষয়ক জ্ঞানের সঙ্গে সেই জ্ঞানের আবার ইতিহাসও আছে। সেই সঙ্গে আর একটি বিষয়ক জ্ঞানের সঙ্গেও তার সম্পর্ক থাকে, অনেক সময় সে-সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। একটি জানতে হলে আরেকটির অন্তত কিছু অংশ জানতে হয়। এ নিয়ে সমস্যা হয়ত এখনও দেখা দেয়নি; যদিও সম্ভব তবু ধরা যাক একুশ অথবা বাইশ শতকেও সমস্যা হয়ত দেখা দিল না, কিন্তু মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার শনৈঃ শনৈঃ যে হারে বাড়ছে তাতে কয়েক হাজার বছর পরে একদিন সমস্যা দেখা দেবেই : সেটা হচ্ছে স্মৃতির সমস্যা। স্মৃতি দিয়েই জ্ঞানের ধারাবাহিকতা। সাধারণ মানুষ আজ পর্যন্ত মোটামুটি যে-ইতিহাস জানে—সব কথা নয়, মানুষের মোটামুটি যে ইতিহাস জানে–তা হচ্ছে পাঁচ-ছয় হাজার বছরের ইতিহাস। আরও জানে তার আগেকার মানুষের ইতিহাসের কয়েকটি রেখার পরিচয় মাত্র। মানুষ তখন ঘর-সংসার শুধু করেনি, প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করেছে। তারপর গোত্রে-গোত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে অনেক হাজার বছর ধরে। অলিখিত সে ইতিহাস । নানা সূত্রে সে-ইতিহাসের আভাস মাত্র পাওয়া যায়। কিন্তু কয়েক হাজার বছর থেকে মানুষের সে-ইতিহাস তা ক্রমেই বর্ধিত পরিমাণে লিখিত ইতিহাস;

যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস শুধু নয়, মানুষের সবরকম জ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাস। আর এই লিখিত ইতিহাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রায় জ্যামিতিক হারে। একজন মানুষের পক্ষে সারাজীবনে এই ইতিহাস জানাই দুরূহ হয়ে উঠেছে, মানুষ তাই এখন জানছে শুধু বিশেষীকৃত ইতিহাস। এক হিসাবে বলা চলে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্ৰ মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতি পরস্পরের সংস্পর্শে এসে ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং একটা বিশ্বসংস্কৃতি রূপলাভ করছে, তার নতুন-নতুন রূপলাভ ঘটছে অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় । অন্য হিসাবে বলা চলে মানুষের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিভাগ ক্রমেই বিভক্ত হয়ে পড়ছে এবং যতদিন যাবে ততই অপরিমিতরূপে বিভক্ত হয়ে যাবে। সব স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজের ক্ষেত্রেই এটা ঘটছে, কোনো সমাজই তার সংস্কৃতিসহ একই রকম চিরদিন থাকছে না। সেই সঙ্গে সমাজের মানসিক সম্পদ—তার সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান-সংস্কৃতি একই রকম থাকছে না। জীবন্ত সংস্কৃতির সব ধারা জীবন্ত থাকছে না, অনেক ধারার মৃত্যু ঘটছে, এমনকি এক সংস্কৃতির বিলুপ্তির পর আরেক সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটছে। যেমন ব্যক্তির তেমনি এক-একটি সমাজের মৃত্যু ঘটছে, জাতির মৃত্যু ঘটছে, কিন্তু মানবীয় ধারা বেঁচে থাকছে, মানবীয় সংস্কৃতি বেঁচে থাকছে। কিন্তু যে-সব সংস্কৃতি, সমাজ অথবা জাতির মৃত্যু ঘটছে তারা মৃত্যুর পর ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে এবং শুধু ইতিহাস হিসাবেই বেঁচে থাকছে।

এই ইতিহাসের স্মৃতির ভার একদিন মানুষের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠবে মনে হয়। দীর্ঘ দীর্ঘকাল পরে এই ইতিহাসকে জানতে হলে সব জ্ঞানার্থীকে একদিন ছবির অ্যালবামের মতো দ্রুত পাতা উল্টিয়ে যেতে হবে শুধু খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনোযোগ দিয়ে দেখার অবসর থাকবে না। এক-এক রকম জ্ঞানের জন্য থাকবে এক-এক রকম অ্যালবাম। কিন্তু এই উপমার মধ্যে কিছু ফাঁকি আছে। অ্যালবাম তো শুধু দেখার জন্য, কিন্তু অ্যালবাম বলে বর্ণিত মানুষের এই ইতিহাস দেখার জন্য নয়, পড়ার জন্য; কেননা না পড়লে অতীতের কিছুই জানা যায় না । অতীতের যা-কিছু বেঁচে থাকে তাকে ভালো করে জানতে হলে শুধু দেখলে চলে না, অথবা দেখার বিশেষ কিছু থাকে না, পড়তে হয়। কিন্তু কী পড়বে তখনকার মানুষ? গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, না এইসবের ইতিহাস? কোনো ভাষার কীর্তিমালার ইতিহাস? আমরা এখন একটি অথবা দুটি অথবা কয়েকটি ভাষার কয়েকটি কীর্তিমালার কথা ব্যক্তিগতভাবে জানতে পারি মাত্র। কিন্তু আমাদের নিজেদেরই ভাষার অন্তর্গত সাহিত্যের একটা বড় অংশকে আমরা প্রায় জানি না, কেবল রুচির জন্য অথবা কালের দূরত্বের জন্য। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাকে নিয়ে সেই কথা। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা এমনই সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে যে, একদিন কোনো একজন মানুষ হয়ত অনেক বিষয়েই সাধারণ জ্ঞানও রাখতে পারবেন না, একটি বিষয়ে সুপণ্ডিত হলেও অন্য বিষয়ে তিনি নিতান্ত অজ্ঞ থেকে যাবেন । এমন দিনও আসতে পারে যখন মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে না। এখনই তো কোনো উচ্চশিক্ষিত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি আইনস্টাইন অথবা অ্যাস্ট্রোনমির সর্বশেষজ্ঞাত জ্ঞানের সঙ্গে চিন্তার সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারেন না ।

এদিক দিয়ে অশিক্ষিত অসংস্কৃত মানুষদের সুবিধা। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, উৎপাদন এবং প্রজননের মধ্যেই তাদের জীবন, তারা স্মৃতির ভারে পীড়িত নয়, কৌতূহলের উত্তেজনায় চঞ্চল নয়, নতুন নতুন আবিষ্কারের কৃতিত্বে উচ্চকিত নয় । স্থান কাল চেতনা ঈশ্বর—এইসব প্রশ্ন তাদের কাছে কিছুই নয়, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, জন্ম-মৃত্যু—এইসবই তাদের কাছে জ্বলন্ত সমস্যা। এই নিয়ে তাদের জীবনমরণ। কিন্তু শুধু তাদের নিয়ে তো পৃথিবী নয় এবং ইতিহাস নয়। ইতিহাস তাদের কাছে কিংবদন্তি, অথবা কিংবদন্তিই তাদের কাছে ইতিহাস? শুধু তাদেরকে নিয়ে মহাজগতে মহামানুষের জীবন নয়, কেননা তাদের চেতনা খণ্ডিত। ঐ সব প্রশ্ন তাদের কাছে কোনো প্রশ্নই নয় । ইতিহাস সৃষ্টিতে তারা সহায়তা করে কিন্তু ইতিহাস তারা লিপিবদ্ধ করে না, কেননা স্মৃতির ভারে তারা পীড়িত নয়।

স্মৃতির ভারে যে পীড়িত, সমস্যাটা তার। তার কাছে স্থান কাল চেতনা এবং এইসবের ধারাবাহিকতা সত্য এবং এই সত্যের মধ্যেই সে অমর—অর্থাৎ আজ পর্যন্ত। ভবিষ্যতেও সে অমর থাকবে, কিন্তু কতদিন? প্রশ্ন হচ্ছে, সে নিজেই অমর হতে চাইবে কি না, ঐ অপরিসীম স্মৃতির বোঝা নিয়ে। যা স্মৃতির বস্তু তা স্মৃতিতে থাকলেই তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, কিন্তু সৃষ্টির ভার একদিন অসহনীয় হয়ে উঠলে সেই ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়ে যাবে। ইতিহাসের প্রকৃত চেতনা কি সেদিন মানবসমাজে থাকবে? আগামী দু-এক লক্ষ বছরের মধ্যে একদিন এ-সমস্যা দেখা দেবে, মনে হয়। আগামী কোটি বছরে তো মানুষের অবস্থা অকল্পনীয়। গত কোটি বছরের ইতিহাসের সমস্যা অনুরূপ। সে-ইতিহাসকে নানা জটিল পন্থায় আবিষ্কার করে নিতে হয়, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে ঘটনার যেমন ভিড় তাতে আগামী কোটি বছর কি মানুষ বাঁচবে? দু-চার লাখ বছর পরেই সে ক্লান্ত, ক্লান্ত, ক্লান্ত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুতর কথাটা হচ্ছে এই যে, নতুন-নতুন মারণাস্ত্র যে-হারে উদ্ভাবিত হচ্ছে, এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করা যে উচিত নয় সে-জ্ঞান এবং নৈতিকতার বিকাশ কি সেই হারে বাড়ছে? রণনীতি এখন এই পর্যায়ে উঠেছে যে যুদ্ধে প্রতিপক্ষের যে-সব মানুষ মরে তারা আর মানুষ নয়, সংখ্যা মাত্র । এমন দিন হয়ত আসছে যখন যে-কোনো সংখ্যার পর দু-চারটে শূন্য শুধু শূন্য ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। এখনি তো পূর্ব-পশ্চিমের মহাশক্তিদের ভাণ্ডারে যে-পরিমাণ মারণাস্ত্র মজুদ আছে তাই দিয়ে মানবপ্রজাতির দশ-বিশ বার আত্মহত্যা করা সম্ভব। সুতরাং এমন ভয়াবহ পরিণাম এড়াতে হলে শুভবোধ, নৈতিকতাবোধ ও মনুষ্যত্ববোধের বিপুল জাগরণ ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই ।

https://www.munshiacademy.com/চেতনার-অ্যালবাম-আবদুল-হক/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *