চর্যাপদের নামকরণ: ইতিহাস, বিতর্ক

Spread the love

📜 চর্যাপদের নামকরণ: ইতিহাস, বিতর্ক ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ কেবল ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে নয়, তার নামকরণ নিয়েও একাধিক বিতর্ক ও মতভেদে পরিপূর্ণ। প্রাচীন পুঁথির নাম কী ছিল, চর্যাপদ নামটি কবে এবং কীভাবে জনপ্রিয় হলো, আর পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে কী বিতর্ক রয়েছে—এই প্রবন্ধে সেই প্রশ্নগুলির উত্তর অনুসন্ধান করা হয়েছে।

🏛️ চর্যাপদের আবিষ্কার ও নাম

চর্যাপদ নামটি জনপ্রিয়তা পেলেও, এটি আদিতে চর্যাগীতির আসল নাম ছিল না। ১৯০৭ সালে ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের রাজগ্রন্থাগার থেকে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন, যেটির নাম ছিল “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”। এই নামটি এসেছে মূল পাণ্ডুলিপিতে সংযুক্ত সংস্কৃত টীকার সূত্রে, এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থেও এই নামটি ব্যবহার করেন।

📘 সংক্ষিপ্ত নামের প্রয়োগ

পরে এই গ্রন্থকে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে সহজবোধ্য করতে এবং সাহিত্যচর্চায় গ্রাহ্য করতে অনেক সময় “চর্যাপদ”, “চর্যাগীতি” বা “বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে অভিহিত করা হয়। তবে এই সকল নাম পরবর্তীকালের নামকরণ।

📚 নাম নিয়ে বিতর্ক: ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ নাকি ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’?

প্রাথমিকভাবে পাওয়া নেপালী পুঁথিটি ছিল মূল পাণ্ডুলিপির অনুলিপি, অর্থাৎ এটি ছিল এক ধরনের প্রতিলিপি বা নকল। এর ফলে মূল পাঠের বিশুদ্ধতা এবং পাণ্ডুলিপির নাম নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়।

🔍 বিধুশেখর শাস্ত্রীর মত

১৯২৮ সালে মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী চর্যাপদের প্রথম পদের উপর লিখিত সংস্কৃত টীকাটি উদ্ধৃত করেন:

“শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্যচর্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মল গিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।”

এই শ্লোকে ব্যবহৃত “আশ্চর্যচর্যাচয়” শব্দটি তিনি মূল গ্রন্থের নাম হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেন। তাঁর মতে, “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” আসলে নকলকারীর ভুল পাঠ, এবং আসল নামটি ছিল “আশ্চর্যচর্যাচয়”।

❗ এই মত নিয়ে আপত্তি

এই মতের বিরোধিতা করেন প্রখ্যাত পণ্ডিত আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আশ্চর্যচর্যাচয়” নামটি যুক্তিযুক্ত হলেও সেটিকে এককভাবে গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ তা টীকার শ্লোকের একটি অংশমাত্র।

⚖️ চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়: একটি সমন্বিত প্রস্তাব

বিখ্যাত গবেষক প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার প্রকৃত নাম হিসেবে “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” নামটি প্রস্তাব করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়” ও “আশ্চর্যচর্যাচয়” এই দুই নামকে একত্রে মিলিয়ে নতুন একটি যৌগিক নাম গ্রহণ করা যেতে পারে।

তবে এই মতকেও খণ্ডন করেন অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়” একটি আধুনিক পণ্ডিতকৃত “জোড়কলম শব্দ”, যার ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তাঁর যুক্তি অনুযায়ী, এমন একটি নাম যা আদিতে কোথাও ব্যবহৃত হয়নি, সেটিকে প্রকৃত বা মৌলিক গ্রন্থনাম হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক নয়।

📜 আধুনিক গবেষণা ও তিব্বতি সূত্র

চর্যাপদের মূল সংস্করণ সম্ভবত তিব্বতি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল, এবং সেই সূত্র থেকেই অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন আধুনিক গবেষকরা। তিব্বতের “তেঙ্গুর গ্রন্থমালা” থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অনুমান করা যায়, মূল পাণ্ডুলিপির নাম ছিল “চর্যাগীতিকোষ” এবং তার উপর রচিত সংস্কৃত টীকাটির নাম ছিল “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”

✅ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের চূড়ান্ত মত

এই তথ্যের ভিত্তিতে অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মত দেন যে, চর্যাগীতির মূল নাম ছিল চর্যাগীতিকোষ, এবং চর্যাচর্যবিনিশ্চয় ছিল তারই ভাষ্য বা টীকা।

🧠 বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন

চর্যাপদের নামকরণ নিয়ে বিতর্ক ও মতানৈক্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। নিচে এই বিতর্কের মূল পয়েন্টগুলো সারসংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

গবেষক প্রস্তাবিত নাম যুক্তি সমালোচনা
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাচর্যবিনিশ্চয় মূল সংস্কৃত টীকা থেকে নেওয়া অনুলিপি হওয়ায় বিশুদ্ধতা সন্দেহজনক
বিধুশেখর শাস্ত্রী আশ্চর্যচর্যাচয় শ্লোক থেকে সম্ভাব্য মূল নাম আংশিক তথ্যের উপর নির্ভরশীল
প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় দুটি নামের সমন্বয় আধুনিক কল্পিত নাম, ঐতিহাসিক ভিত্তি দুর্বল
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় চর্যাগীতিকোষ (মূল), চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (টীকা) তিব্বতি গ্রন্থমালার তথ্য অনুসারে আধুনিক গবেষণার ভিত্তিতে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য

📌 উপসংহার

চর্যাপদ নামটি এখন বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর মূল নাম নিয়ে বিতর্ক এখনো বিদ্যমান। এই বিতর্ক শুধুমাত্র একটি নামকে ঘিরে নয়—এটি মূলত বাংলা সাহিত্যের উৎস, প্রাচীন ধর্মীয় চর্চা, ভাষার বিবর্তন ও তিব্বতীয় পাণ্ডুলিপিচর্চার সাথে যুক্ত।

এখনকার প্রেক্ষিতে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নামটিকেই গবেষকরা সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন, যদিও চর্যাপদ নামটিই জনপরিসরে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বুঝতে হলে এই নামকরণ বিতর্ক জানা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি আমাদের সাহিত্য-উৎপত্তির শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

 

📚 তথ্যসূত্র:

  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, Charyacharyavinishchaya, ১৯০৭
  • মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী, ১৯২৮
  • আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, Charyapada o Sekaler Bangla Bhasha
  • প্রবোধচন্দ্র বাগচী, Buddhist Songs and Dohas
  • তেঙ্গুর গ্রন্থমালা, তিব্বতীয় পুঁথি

 

 

চর্যাপদের নামকরণ: ইতিহাস, বিতর্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *