ওবায়েদুল হক: জীবন ও সাহিত্যকর্ম
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক অনন্য নাম ওবায়েদুল হক। তাঁর জীবন ছিল বহুমাত্রিক—তিনি একাধারে সাংবাদিক, কলামিস্ট, সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। সাহিত্যের মাঠে যেমন তিনি নিরবধি চর্চা করে গেছেন, তেমনি চলচ্চিত্রে রেখেছেন ঐতিহাসিক পদচিহ্ন। তাঁর কর্মকৃতি আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে এক শক্তিশালী প্রেরণা হিসেবে বিবেচিত।
🎓 জন্ম ও শিক্ষা
ওবায়েদুল হক জন্মগ্রহণ করেন ৩১ অক্টোবর ১৯১১ সালে, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গ ও আসামের নোয়াখালী জেলার ফেনীতে। তাঁর পিতা বাজলুল হক খান ছিলেন একজন আইনজীবী এবং বেঙ্গল প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য। মাতা ছিলেন আনজুমান নেসা। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে বেড়ে ওঠেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৩৪ সালে এবং পরে ১৯৩৬ সালে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এই শিক্ষাজীবন তাঁকে একজন যুক্তিবাদী, চিন্তাশীল ও সুসংগঠিত মননের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
📰 সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা
ওবায়েদুল হকের সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা ঘটে ১৯৫১ সালে। তিনি Pakistan Observer পত্রিকায় যৌথ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি The Bangladesh Observer পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও মানবিক বিষয়াবলিকে ধারণ করতেন তাঁর লেখায়। তাঁর প্রবন্ধ ও কলামে মানবতা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার সুর উচ্চকিত হতো। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান লেখক।
🎬 চলচ্চিত্রে পথচলা
সাংবাদিকতার পাশাপাশি ওবায়েদুল হক ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে একজন পথিকৃৎ। তিনি প্রথম বাঙালি মুসলিম পরিচালক, যিনি টলিউডে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
🎥 পরিচালিত চলচ্চিত্র:
- দুখে যাদের জীবন গড়া (১৯৪৬): এটি তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রে তিনি “হিমাদ্রি চৌধুরী” নামে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এটি টলিউডে প্রথম কোনো বাঙালি মুসলিম নির্মিত চলচ্চিত্র।
- দুই দিগন্ত (১৯৬৪): একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র যা তাঁর শিল্পনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে।
🏆 সম্মাননা ও পুরস্কার
তাঁর সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অবদান স্বীকৃত হয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তিনি বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হন, যেমন:
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪)
- একুশে পদক (১৯৮১)
- ইউনিসেফ গোল্ড মেডেল (১৯৮৩)
- আব্দুস সালাম স্বর্ণপদক
- জহুর হোসেন স্বর্ণপদক
- কাজী মাহবুবুল্লাহ ও বেগম জেবুন্নেসা ট্রাস্ট স্বর্ণপদক
- অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার
- মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০২)
- হীরালাল সেন পুরস্কার (২০০৩)
👪 ব্যক্তিগত জীবন
ওবায়েদুল হকের পরিবার ছিল সাহিত্য ও শিক্ষা–সচেতন। তাঁর চার পুত্র—মশকুল হক, আরহাম মাসউদুল হক, আনজাম মারুফ, সাজ্জাদ জাবির এবং তিন কন্যা—সালমা আহসান, আসমা হক, নাইমা হক। তাঁর বহু নাতি-নাতনি রয়েছে, যারা দেশের বিভিন্ন পেশায় সাফল্যের সাথে যুক্ত।
🕊️ মৃত্যু
দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে ১৩ অক্টোবর ২০০৭ সালে, ঢাকায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারায় একজন নির্লোভ চিন্তক, সৎ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে।
📚 সাহিত্যকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য
ওবায়েদুল হকের সাহিত্যকর্মে মানবতাবোধ, যুক্তিবাদ, সমাজ সচেতনতা ও ভাষার শিল্পরূপ গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সাহিত্যকে কেবল বিনোদন নয়, বরং সমাজের আয়না ও পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন।
🔚 উপসংহার
ওবায়েদুল হক ছিলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র তিনটি ক্ষেত্রেই অনন্য কৃতিত্ব স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম আজও শিক্ষণীয়, অনুসরণীয় এবং বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক।