আহমদ শরীফ : যুক্তিবাদী চিন্তার পথিকৃৎ মনীষী


আহমদ শরীফ : যুক্তিবাদী চিন্তার পথিকৃৎ মনীষী

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন:
বাংলাদেশের প্রথাবিরোধী ও প্রগতিশীল মনীষী অধ্যাপক আহমদ শরীফ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন আব্দুল আজিজ এবং মাতা মিরাজ খাতুন। শৈশব থেকেই তিনি সাহিত্য, ইতিহাস ও চিন্তাশীল সমাজবোধের পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর কাকা ও পিতৃতুল্য ছিলেন বিখ্যাত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, যিনি বাংলা পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য সুপরিচিত। সাহিত্যবিশারদের স্নেহেই আহমদ শরীফ লালিত-পালিত হন, ফলে সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ গড়ে ওঠে।


শিক্ষাজীবন:

আহমদ শরীফ ১৯৩৮ সালে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন। ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৭ সালে তিনি “সৈয়দ সুলতান, তাঁর গ্রন্থাবলি ও তাঁর যুগ” শীর্ষক গবেষণার জন্য পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন।


পেশাগত জীবন:

১৯৪৪ সালে তিনি দুর্নীতি দমন বিভাগে গ্রিভেন্স অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, তবে নীতিগত কারণে চাকরি ত্যাগ করেন। এরপর শিক্ষকতায় যুক্ত হয়ে ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত লাকসামের পশ্চিম গাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজফেনী ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা করেন।

১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন, সাহিত্যবিশারদের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের দায়িত্বে। পরবর্তীতে তিনি বাংলা বিভাগের লেকচারার, অধ্যাপক, এবং বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি একাধিকবার আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন এবং ১৯৮৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন।


সাহিত্য ও গবেষণা জীবন:

আহমদ শরীফ ছিলেন মূলত গবেষক, চিন্তাবিদ ও ভাষাবিদ। তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা মধ্যযুগের সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বিশ্লেষণে। তাঁর লেখায় ইতিহাস, যুক্তি, বিশ্লেষণ ও মানবতাবাদ মিলেমিশে এক অনন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার সৃষ্টি করেছে।

তাঁর রচনায় বারবার প্রতিফলিত হয়েছে ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মার্ক্সবাদী চিন্তার যৌগিক রূপ। তিনি প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সমাজ পরিবর্তনের পক্ষের তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণ করেছেন।


প্রধান গ্রন্থসমূহ:

মৌলিক গ্রন্থ:

  • বিচিত চিন্তা
  • স্বদেশ চিন্তা
  • কালিক ভাবনা
  • যুগ যন্ত্রণা
  • বিশ শতকের বাঙালি
  • স্বদেশ অন্বেষা
  • মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ
  • বাংলার সুফি সাহিত্য
  • বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা
  • বাংলার বিপ্লবী পটভূমি
  • এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা
  • নির্বাচিত প্রবন্ধ
  • প্রত্যয় ও প্রত্যাশা
  • বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য (দুই খণ্ড)

সম্পাদনা:

  • একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় (১৯৮৭)
  • লায়লী মজনু (১৯৫৭, সম্পাদিত গ্রন্থ)

চিন্তা ও দর্শন:

আহমদ শরীফের দর্শন ছিল মানবতাবাদ ও মুক্তচিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
তিনি ১৯৬২ সালে লেখা প্রবন্ধে প্রথমবারের মতো “বাংলাদেশ” শব্দটি ব্যবহার করেন এবং রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” কবিতাকে জাতীয় চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেন।

তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ (নিউক্লিয়াস)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক পৃষ্ঠপোষক।


পুরস্কার ও সম্মাননা:

  • একুশে পদক (১৯৯১)
  • স্বদেশ চিন্তা সংঘ কর্তৃক প্রবর্তিত ‘ড. আহমদ শরীফ স্মৃতি পুরস্কার’ তাঁর স্মরণে প্রদান করা হয় প্রতি বছর।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার:

১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, অধ্যাপক আহমদ শরীফ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি চক্ষু ও দেহদান করার অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন, যা তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তাঁর দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য দান করা হয়


উপসংহার:

অধ্যাপক আহমদ শরীফ ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও চিন্তার ইতিহাসে এক অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী মনীষী। তাঁর প্রবন্ধ, গবেষণা ও তত্ত্বভিত্তিক চিন্তা আজও প্রজন্মকে স্বাধীন চিন্তা ও মানবতার পথে অনুপ্রাণিত করে।
বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাঁর চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণাদায়ক।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *