আবু ইসহাক : একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশি সাহিত্যিক


আবু ইসহাক : একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশি সাহিত্যিক

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন:
বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক আবু ইসহাক জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ১ নভেম্বর (বাংলা ১৫ কার্তিক ১৩৩৩) মাদারীপুর মহকুমার নড়িয়া থানার শিরঙ্গল গ্রামে। তিনি ছিলেন একজন গভীরভাবে দেশপ্রেমিক, সমাজসচেতন ও মানবতাবাদী লেখক। তাঁর মৃত্যু ঘটে ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়।


শিক্ষাজীবন:

আবু ইসহাক ১৯৪২ সালে নড়িয়া থানার উপসী বিজারি তারাপ্রসন্ন ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপসহ মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. পাস করেন।
পরবর্তীতে তিনি ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবন শেষে তিনি সরকারি প্রশাসনে যুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সততার সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।


কর্মজীবন:

প্রথম জীবনে আবু ইসহাক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শক পদে যোগদান করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে তিনি পুলিশ বিভাগে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদে কর্মরত ছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থায় (NSI) উপ-পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বার্মার আকিয়াবে বাংলাদেশের ভাইস-কনসাল, এবং ১৯৭৬ সালে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৯ সালে তিনি খুলনা বিভাগের NSI প্রধান হন এবং ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।


সাহিত্যিক জীবন:

আবু ইসহাকের সাহিত্য জীবন শুরু হয় খুব অল্প বয়সে। মাত্র একুশ বছর বয়সে, ১৯৪৬ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর অমর সৃষ্টি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাস, যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে। উপন্যাসটি গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র্য, যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়কে গভীর বাস্তবতায় তুলে ধরে এবং বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

তিনি শুধুমাত্র উপন্যাসকার নন, বরং একজন সফল অভিধান প্রণেতাও ছিলেন। তাঁর রচিত ‘সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’ (দুই খণ্ড, ১৯৯৩ ও ১৯৯৮) বাংলা ভাষার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এই অভিধানের বিশেষত্ব হলো— শব্দের অর্থ ছাড়াও প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দের বিস্তারিত তালিকা প্রদান। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর অভিধানে ‘অন্ধকার’ শব্দের ১২৭টি প্রতিশব্দ উল্লেখ রয়েছে।


প্রধান গ্রন্থসমূহ:

উপন্যাস:

  1. সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৫৫) — সমাজবাস্তবতার এক অনন্য নিদর্শন; ১৯৭৯ সালে এ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়।
  2. পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬) — সামাজিক উপন্যাস।
  3. জাল (১৯৮৮) — একটি গোয়েন্দা উপন্যাস।

গল্পসমগ্র:

  • অভিশাপ (প্রথম গল্প)
  • হারেম (১৯৬২)
  • মহাপতঙ্গ (১৯৬৩)
  • জোঁক

পুরস্কার ও সম্মাননা:

আবু ইসহাক তাঁর সাহিত্য ও প্রশাসনিক কৃতিত্বের জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হন—

  • বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২–৬৩)
  • সুন্দরবন সাহিত্য পদক (১৯৮১)
  • একুশে পদক (১৯৯৭)
  • স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) (২০০৪)

সাহিত্যচর্চার বৈশিষ্ট্য:

আবু ইসহাকের সাহিত্য সমাজ ও বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর রচনায় কৃষক, দরিদ্র মানুষ, সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠী এবং রাজনীতি-নির্ভর সংকটময় সময়ের মানুষের কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবে ধ্বনিত হয়েছে। ভাষা ছিল সহজ, বাস্তব ও মানবিক সংবেদনপূর্ণ।


উপসংহার:

বাংলা কথাসাহিত্যে আবু ইসহাক এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। সাহিত্যে তাঁর অবদান কেবল একটি সময়ের দলিল নয়, বরং বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির গভীর চেতনার প্রতিফলন। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, কূটনীতিক ও সংস্কৃতিচিন্তক — যাঁর কর্ম ও কৃতিত্ব আজও বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে অমলিন।


📚 তথ্যসূত্র:

  1. বাংলা একাডেমী গ্রন্থপঞ্জি
  2. উইকিপিডিয়া – “আবু ইসহাক”
  3. বাংলা সাহিত্য ইতিহাস, খণ্ড-৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *