🌿 আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : আলোকিত মানুষের স্থপতি
বাংলাদেশের সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এমন এক নাম, যিনি “আলোকিত মানুষ” গঠনের ধারণাকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষক, সাহিত্যিক, সংগঠক, টেলিভিশন উপস্থাপক ও সমাজসংস্কারক— সব ভূমিকায়ই অনন্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে চলেছে সারা দেশে।
🌱 প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষাজীবন
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন কলেজ শিক্ষক।
তিনি ১৯৫৫ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে স্নাতক ও ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
🎓 কর্মজীবন
১৯৬১ সালে তিনি মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর সিলেট মহিলা কলেজ, রাজশাহী কলেজ ও সরকারী বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষকতা করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন।
তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ষাটের দশকে বাংলাদেশের নতুন সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। সাহিত্যপত্র ‘কণ্ঠস্বর’ সম্পাদনার মাধ্যমে নবীন লেখকদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এ সময় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
📚 বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র— যার মূল লক্ষ্য ছিল “আলোকিত মানুষ” তৈরি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পাঠাভ্যাস ও মানবিক মূল্যবোধই একটি সমাজকে টেকসইভাবে পরিবর্তন করতে পারে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র শুধু একটি পাঠাগার নয়; এটি এক মানবিক আন্দোলন। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম শুরু করে, যাতে গ্রামের তরুণরাও বইয়ের আলো পেতে পারে।
✍️ সাহিত্য ও প্রবন্ধ রচনা
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ষাটের দশকে কবি ও প্রবন্ধকার হিসেবে সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর রচনায় মানবিকতা, আত্মসমালোচনা এবং জ্ঞানের আলো অন্বেষণের আহ্বান প্রধান হয়ে ওঠে।
উল্লেখযোগ্য রচনা:
- সংগঠন ও বাঙালি
- ব্রাহ্মণের বাড়ির কাকাতুয়া
🏅 পুরস্কার ও স্বীকৃতি
- রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার (২০০৪) – সমাজ পরিবর্তনের আলোকিত উদ্যোগের জন্য
- একুশে পদক (২০০৫) – শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১২) – প্রবন্ধ সাহিত্যে অবদানের জন্য
- পালমোকন সম্মাননা (২০১৭) – মানবিক শিক্ষাচর্চায় বিশেষ ভূমিকার জন্য
🌺 ব্যক্তিত্ব ও দর্শন
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বাস করেন, “আলোকিত মানুষই সমাজ পরিবর্তনের প্রকৃত শক্তি।” তাঁর চিন্তা, বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ডে মানবতাবাদ, সাহিত্যপ্রেম ও জ্ঞানের চর্চার গুরুত্ব সবসময় প্রধান ছিল।
তাঁর জীবনদর্শন একদিকে যেমন সাহিত্যিক রোমান্টিসিজমে ভরা, অন্যদিকে তা সামাজিক বাস্তবতার মাটিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো।
✨ উপসংহার
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কেবল একজন শিক্ষক বা সংগঠক নন, তিনি এক সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রতীক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও জীবনচিন্তা আজও নতুন প্রজন্মকে শেখায়— জ্ঞান, সাহিত্য ও মানবিকতার আলোই প্রকৃত আলোকিত সমাজ গড়তে পারে।
